Source LINK
ভূমিকা: নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি মহেশখালীর কৃতি সন্তান, বিশিষ্ট মুসলিম মণীষী, আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যক্তিত্ব, খ্যাতিমান আরবী সুসাহিত্যিক ও লেখক আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী শুধু বাংলাদেশে নয় মুসলিম বিশ্বে এক পরিচিত নাম। তার বহুমাত্রিক যোগ্যতার কারণে তিনি দেশে যেভাবে বরেণ্য অনুরূপ আন্তর্জাতিক মণীষার কারণে মুসলিম বিশ্বে সমাদৃত। তিনি এ দেশের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন পরিমণ্ডলে অবদান রেখে চলেছেন। বিশেষত: এ দেশে ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। গতানুগতিক সরকারী মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ও পুরোনো কওমী শিক্ষাব্যবস্থার নিগড় ভেঙে একটি যুগোপযোগী ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার ফর্মুলা উপস্থাপন করে তিনি বেশ আলোচিত হন। তার সে শিক্ষা ব্যবস্থার আলোকে চট্টলায় গড়ে উঠেছে ব্যতিক্রকধর্মী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়া। যা ইতিমধ্যেই বিশ্বের বহু দেশের আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও তিনি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধিত্ব করে এদেশের সুনাম বয়ে এনেছেন। তার বর্ণাঢ্য জীবনালেখ্যে আগামী প্রজন্ম খুঁজে পাবে পাথেয়। এ প্রত্যাশায় হিলফুল-ফুযুল কল্যাণ সংস্থা এ সংবর্ধিত মণীষীর সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
জন্ম ও বাল্যজীবন: মহেশখালীর কেন্দ্রীয় এলাকা, বড় মহেশখালীর জাগিরাঘোনা মহল্লায় অনুমানিক ১৯৩৯ সালে এক মধ্যবিত্ত দ্বীনদার পরিবারে আল্লামা সুলতান যওক নদভীর জন্ম। বাল্য কালেই তিনি মমতাময়ী মা রূহ আফজা বেগমকে হারান। পিতা আলহাজ্ব আবুল খায়ের সাহেব পেশায় ব্যবসায়ী হলেও অত্যাধিক ইবাদত বন্দেগী, তাক্বওয়া-পরহেজগারী, আধ্যত্বিকতা ও তাসাইফের প্রতি ধাবিত হওয়ার কারণে সূফী নামে প্রশিদ্ধ ছিলেন। নানা হযরত মাওলানা মকবুল আহমদ ছিলেন হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেব রহ. এর খলীফা হযরত মাওলানা জাফর আহমদ ওসমানীর খলীফা। পিতা আবুল খায়ের সাহেব রূহানী তরবিয়তের প্রতি আসক্ত হওয়ায় সর্বদা হক্কানী আলেম ওলামার সান্নিধ্য কামনা করতেন। তার পরিবারের সাথে আলেম-ওলামা ও জ্ঞানী-গুণীদের সশ্রদ্ধ ভালবাসার সম্পর্ক ছিল। বিশেষত হাকীমুল উম্মত থানভীর প্রসিদ্ধ খলীফা শর্ষদ্বীর মাওলানা নূর বকস সাহেব রহ. সাথে এবং তার ইন্তেকালের পর পটিয়ার হযরত মাওলানা মুফতি আযিযুল হকের রহ. সাথে ছিল তার আত্ত্বিক সম্পর্ক। তাই ছোটকাল থেকেই তার কোমল মনে দ্বীনি কথাবার্তা, যিকির আযকারের হৃদয়গ্রাহী গুঞ্জরণের সুপ্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এভাবে এক রূহানী দ্বীনি পরিবেশে স্বভাবজাত ভদ্রতা, জ্ঞান পিপাসা, বিশুদ্ধ আক্বিদার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠে তার বাল্যজীবন।
শিক্ষা জীবন: নিজ গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে আল্লামা সুলতান যওক নদভীর লেখাপড়ার হাতেকড়ি হয়। সেখানে তিনি বাংলা, অংক, সমাজপাঠ, কায়েদা, আমপারা ও কুরআনের প্রাথমিক পাঠসমূহ গ্রহণ করেন। তারপর স্থানীয় নতুন বাজার জামে মসজিদের অধীনে পরিচালিত ফোরকানিয়ায় কিছুদিন কুরআন মাজীদসহ অন্যান্য বুনিয়াদী তালীম গ্রহণ করেন। তার বাল্যকালের শিক্ষকগণের মধ্যে মরহুম মাওলানা ফজল আহমদ সাহেবের নাম উল্যেখযোগ্য। অত:পর মহেশখালীর প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসায়ে ইসলামিয়া গোরকঘাটায় মিজান-মুনশাইব জামাত ( ৫ম শ্রেণী সমমান) ভর্তি হয়ে তিনি তার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেন। তারপর ইমদাদিয়া কাসেমুল উলুম নতুন বাজার মাদ্রাসায় ভর্তি হলেও সেখানে বেশী দিন লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেনি। হযরত মাওলানা ফজল আহমদ সাহেবের কাছে কিছুদিন প্রাইভেটভাবে পড়েন। ১৩৬৯ হিজরী মাদ্রাসা আশরাফুল উলুম ঝাপুয়ায় ভর্তি হন। আশরাফুল উলুম ঝাপুয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালীন সময়ে এক সফরে জগতবিখ্যাত বুজুর্গ হযরত মুফতী আজিজুল হক সাহেব রহ. সেখানে গেলে তিনি আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভীর অপার সম্ভাবনাময় সুপ্ত প্রতিভা আঁচ করতে পেরে তাকে প্রসিদ্ধ দ্বীনি বিদ্যাপীঠ জামেয় ইসলামিয়া পটিয়ায় গমনের পরামর্শ দেন। ফলে ঝাপুয়ায় একনিষ্ঠভাবে তিন বছর শিক্ষা লাভের পর ১৩৭২ হিজরীতে পাড়ি জমান জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায়। সেখানে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ভর্তি হন। তদানীন্তন দেশ সেরা উস্তাদদের দয়ালু তত্বাবধানে ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকে তার সুপ্ত মেধা ও প্রতিভা। পাঠ্যক্রমের নিয়মিত পড়ালেখার সাথে সাথে চলতে থাকে উর্দু, ফার্সী আর আরবী সাহিত্যের অনুশীলন। ধারাবাহিক অধ্যয়নের কারণে তার মেধার এমন স্ফুরণ ঘটে যে, মাদ্রাসার বার্ষিক রিপোর্টগুলোতে ছাত্রদের সর্বোত্তম সৃষ্টিকর্ম হিসেবে প্রকাশিত রচনার মধ্যে তার রচিত উর্দু, ফার্সী, আরবী বিভিন্ন ক্বসীদা/কবিতা নিয়মিত স্থান পেত। এমনকি কোন গণ্যমান্য মেহমানের মানপত্র রচনা, উস্তাদদের বিভিন্ন ইলমী সহযোগিতা ইত্যাদির দায়িত্ব পড়ত তার উপর। এভাবে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে সুদীর্ঘ ছয় বছর পড়ালেখা করে ইসলামী শরীয়াহ বিভাগ হতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে দাওরায়ে হাদীসের সনদ লাভ করেন। ১৩৭৮ হিজরী মুতাবেক ১৯৫৯ সালে আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভীর প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা শেষ হয়। অবশ্য পরবর্তীতে ১৪০৪ হিজরী সালে তিনি ভারতের লক্ষ্মৌস্থ দারুল উলুম নদওয়াতুল ওলামা হতে সম্মানসূচক ‘আলমিয়াত’ ডিগ্রী লাভ করে নদভী খেতাবে ভূষিত হন।
আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী যাদের পরশ লাভে ধন্য হয়েছেন: দেশ-বিদেশের অসংখ্য শ্রেষ্ঠ বিদ্বান ও বুজুর্গ ব্যক্তির সান্নিধ্য লাভে তিনি ধন্য হয়েছেন। তম্মধ্যে উল্যেখযোগ্য হচ্ছেন হযরত মাওলানা ইমাম সাহেব মোহরভী রহ., হযরত আলহাজ্ব মাওলানা ইফনুছ সাহেব রহ., হযরত মাওলানা আমীর হোসাইন মীর সাহেব রহ., হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইছহাক গাজী সাহেব রহ., হযরত মাওলানা মুফতী ইবরাহীম সাহেব রহ., মাওলানা আলী আহমদ বোয়লভী সাহেব রহ., হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইছহাক হ্ণীলাভী সাহেব মু:জি: (প্রকাশ ছদর সাহেব হুজুর) হযরত মাওলানা নুরুল ইসলাম ক্বদীম রহ., হযরত মাওলানা ইহসানুল হক সাহেব সন্দ্বীপী মু:জি: হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ সাহেব রহ. হযরত মাওলানা হাকীম নুরুজ্জামান সাহেব রহ., হযরত মাওলানা আতীক সাহেব রহ., হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সাহেব রহ., হযরত মাওলানা ফজল আহমদ সাহেব রহ. মাওলানা আব্দুল বারী রহ., মাওলানা আবুল কালাম আনোয়ারভী রহ., হযরত মাওলানা আব্দুস সালাম বণিগ্রামী রহ., হযরত মাওলানা মুজহেরুল হক কুতুবী রহ., হযরত মাওলানা বদীউর রহমান সাহেব রাউজানী প্রমূখ।
বর্হিবিশ্বের যে সকল মনীষীদের কাছ থেকে হাদীছের সনদ অর্জন করেছেন:
হাদীসের উচ্চতর সনদের প্রত্যাশায় তিনি বিদেশের বহু প্রথিতযশা মুহাদ্দিসদের সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছেন। তম্মধ্যে উল্যেখযোগ্য হলেন,
১. তিরমিযী শরীফের বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ মা‘আরিফুস সুনান এর রচয়িতা আল্লামা সৈয়দ ইউসুফ বিন্নুরি রহ. পাকিস্তান- ১৯৫৮ সাল।
২. হাদীস বিশারদ (হাফেজুল হাদীস) আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রহ. পাকিস্তান- ১৩৯০ হিজরী।
৩. মুয়াত্তা মালেকের ব্যাখ্যাগ্রন্থ আওজাজুল মাসালিকের রচয়িতা শায়খুল হাদীস আল্লামা মুহাম্মাদ জাকারিয়া কান্দলভী রহ. পাকিস্তান- ১৯৭৭ সাল।
৪. আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ.- ১৪০১ হিজরী।
৫. আল্লামা মঞ্জুর নোমানী রহ.- ১৪০১ হিজরী।
৬. দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম ও শাইখুল হাদীস আল্লামা ক্বারী মুহাম্মদ তৈয়ব রহ. - ১৯৭৮ সাল।
৭. হযরত মাওলানা ফখরুল হাসান রহ. প্রধান শিক্ষক দারুল উলুম দেওবন্দ- ১৯৭৮ সাল।
৮. হযরত মাওলনা মে’রাজুল হক রহ. মুহাদ্দিস দারুল উলুম দেওবন্দ- ১৯৭৮ সাল।
৯. সিরিয়ার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দেস আল্লামা শেখ আব্দুল ফততাহ আবু গুদ্দাহ রহ.- ১৪১৩ হিজরী।
১০. হযরত মাওলানা আশেক ইলাহী আল-বরনী রহ. (মুহাজির মদীনা) - ১৪১৮ হজরী।
কর্ম জীবন: ১৯৫৯ সালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপনের পর পরম শ্রদ্ধেয় উস্তাজ হযরত মুফতী আজিজুল হক সাহেবের পরামর্শক্রমে মাদ্রাসা রশিদিয় বশরত নগর (চন্দনাইশ)-এ আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভীর শিক্ষকতা জীবনের সূচনা ঘটে। মাদ্রাসায়ে রশিদিয়ায় সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে প্রায় দুই বছর শিক্ষকতার পর ১৯৬০ সালে নেজামে ইসলাম পার্ঠির প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা আতহার আলীর আহবানে কিশোরগঞ্জের তদানীন্তন বিখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইমদাদিয়ায় চলে যান। জামিয়া ইমদাদিয়াকে উপলক্ষ তিনি তখন একটি আরবী কবিতা লিখেন যা ঢাকার প্রসিদ্ধ আরবী সাহিত্যিক আল্লামা আব্দুর রহমান কাশগরী রহ. দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং প্রীত হন। ১৩৮০ সালে মাদ্রাসা হুসাইনিয়া ইয়াহয়াউল উলুম বোয়ালিয়ার মুহতামিম, আল্লামা সুলতান যওক নদভীর মুহতরম শশুর হযরত আলহাজ্ব মাওলানা আলী আহমদ সাহেবের অনুরোধে এক বছর সেখানে অবস্থান করেন। কারণ তার শশুর সাহেব স্বপরিবারে সৌদিয়া হিযরত করেছিলেন। ১৩৮১ হিজরী স্বীয় মুরব্বী হযরত মাওলানা হাজ্বী ইউনুছ সাহেব রহ. এর ডাকে সাড়া দিয়ে ইলম অর্জনের মাতুলালয় জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় পাঠ্যক্রমের উপরের স্তরের কিতাবগুলো পড়ানোর পাশাপাশি মাদ্রাসার সাহিত্যনুরাগী ছাত্রদেরকে ছাত্রদেরকে উর্দু বক্তৃতা প্রশিক্ষণ, উর্দু ভাষায় প্রবন্ধ লেখার নিয়ম-কানুন, বিভিন্ন ভায়ায় কাব্য চর্চা, কবিতা পাঠের আসরের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার মত সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের দায়িত্বও তিনি স্বার্থকতার সাথে পালন করতে থাকেন। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় ‘আল-কাসেম’ নামে উর্দু ভাষায় একটি সাপ্তাহিক দেয়ালিকা প্রকাশ পেত। উল্যেখ্য, তখন এ উপমহাদেশে উর্দুই ছিল সাহিত্যচর্চার প্রধান মাধ্যম। তার সংস্পর্শে এ সময় জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ার ছাত্রদের মধ্যে বিভিন্ন ভায়ায় সাহিত্য চর্চার যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তার ছিল অভূতপূর্ব। উর্দু ভাষায় তার ঈর্ষণীয় পান্ডিত্যের কারণে শিক্ষাঙ্গনের বাইরেও তিনি অনেক উর্দু ভাষাভাষীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সর্বোচ্চ আসন অলংকৃত করে প্রসংশিত হন।
১৩৮৫ হিজরী মোতাবেক ১৯৬৫ সালে একটি যুগোপযোগী আদর্শ দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মানসে তিনি প্রথমবারের মত পটিয়া ত্যাগ করেন এবং সমমনা বন্ধুবর আলেম কামাল উদ্দীন রহ. কে সাথে নিয়ে আগ্রাবাদে কাসেমুল উলুম নামে একটি আদর্শ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৩৮৫ হিজরী সালে যুগশ্রেষ্ঠ বুযুর্গ আল্লামা মুহাম্মাদ হারুন বাবুনগরী রহ. এর পরামর্শে মাদ্রাসায়ে আযীযুল উলুম বাবুনগরে শিক্ষক হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন। এখানেই তিনি উপরস্তরের আরবী সাহিত্য ও হাদীসের পাঠ দানের পাশাপাশি মুফতি পদে দায়িত্ব পালন করেন এবং ছাত্রদের সাহিত্য চর্চার জন্য ‘নাদিয়াতুল আদব’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি তিনি যুগশ্রেষ্ঠ বুযুর্গ আল্লামা মুহাম্মাদ হারুন বাবুনগরীর সান্নিধ্যে থেকে আধ্যাত্মিক জগতেও পরিপক্ক হয়ে উঠেন। সুদীর্ঘ চার বছর পর ১৯৭০ সালের সঙ্গীন সময়ে তিনি ‘সুজাআত’ নামক একটি উর্দু পত্রিকায় লিখনী বিভাগে যোগ দেন। পরবর্তীতে তার উর্দু ভাষায় দক্ষতা বুঝতে পেরে পত্রিকার সম্পাদক তাকে প্র“পরিডার বিভাগে প্রমোশন দেন। পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলে তার যোগ্যতার প্রতি এতই মুগ্ধ ছিলেন যে, ব্যাকরণগত যে কোন সমস্যায় পড়লে তারা আল্লামা সুলতান যওক নদভীর শরণভাপন্ন হতো। এ পত্রিকায় তার বেশ কিছু প্রবন্ধ ও কবিতাও প্রকাশিত হয়।
১৯৭১ সালের রাজৗনতিক পটপরিবর্তনের পর ১৩৯২ হিজরী তিনি জামেয়া ইসলামিয় পটিয়ায় দ্বিতীয় বারের মত তালীমী খেদমতে নিয়োজিত হন। তাহাভী শরীফ, তিরমিজী শরীফ, মিশকাতসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কিতাবের দরস প্রদানের পাশাপাশি আরবী ভাষা বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতা, আরবী ভাষা একাডেমি প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি সৃজনশীল কর্মের আঞ্জাম দিতে থাকেন। এ সময় ‘আসসুবহুল জদীদ’ নামে একটি ত্রৈমাসিক আরবী পত্রিকা তার সম্পাদনায় নিয়মিত বের হতো, যা অল্প সময়ের মধ্যে বিদগ্ধ গুণীজনের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিল।
আল্লামা সুলতান যওক নদভীর ভারত সফর ও নদওয়াতুল ওলামার সাথে সম্পৃক্ততা:
১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত আন্তর্জতিক সাহিত্য সেমিনারে অংশ নিতে তিনি ভারত গমন করেন এবং বিশ্ববিখ্যাত নদওয়াতুল ওলামায় দুই মাস অবস্থান করেন। এ সময়ের মধ্যে প্রখ্যাত আরবী সাহিত্যিকদের সাথে তার পরিচয় ঘটে। ১৯৮৬ সালে রাবেতা আল-আদব আল-আসলামীর ট্রাস্ট বোর্ডের সদস্য হিসেবে আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী নিযুক্ত এবং বাংলাদেশ আঞ্চলিক অফিসের চেয়ারম্যান ঘোষিত হন। সেখানে অবস্থানকলে নদওয়ার মত বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে একটি ইনশা ও আদব ক্লাস নিয়ে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করেন। তার প্রখর মেধা ও যোগ্যতার কারণে নদওয়ার কর্তৃপক্ষ তাকে সম্মানসূচক উপাধী ‘নদভী’ লেখার অনুমতি প্রদান করেন। ১৯৮৪ সালে তারই আমন্ত্রণে বিশ্ববিখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. বাংলাদেশ সফর করেন এবং যুগ চাহিদার মানসে একটি স্বতন্ত্র মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাকে পরামর্শ দেন। তারই উদ্যোগে রাবেতা আল-আদব আল-ইসলামীর ব্যবস্থাপনায় জামেয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়ায় ১৯৯৪ সালে আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভীর সাভাপতিত্বে ‘প্রাচ্যের জাতিগুলোর ভাষা ও সাহিত্যে ইসলামী প্রভাব’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সাহিত্য সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি সাহিত্যিকগণ উপস্থিত ছিলেন। সে আন্তর্জাতিক সেমিনারে আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী ‘বাংলা সাহিত্যে ইসলামের প্রভাব (আরবী ভাষায়)’ বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
জামেয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়া ঃ
আল্লামা সুলতান যওক নদভীর স্বপ্নের বাস্তবায়ন: ১৯৮৫ সালে জামেয়া পটিয়া থেকে ইস্তেফা দিয়ে জামেয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। জ্ঞানের প্রাচীন মূলনীতির উপর অটল থেকে আধুনিক উপকারী বিষয়গুলোর সমন্বয়ে গঠিত উক্ত মাদ্রাসার সিলেবাসটি বেশ যুগোপযোগী বলে দেশ-বিদেশে প্রমাণিত ও সমাদৃত হয়েছে। বিশ্বের নামকরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এ জামেয়ার শিক্ষাক্রমকে অনুমোদন করেছে এবং বিশ্বের বহু দেশ থেকে এমনকি আরব বিশ্ব থেকে পাঁচশত যোগ্য ছাত্র বের হয়ে দেশ-বিদেশের খেদমতে নিয়োজিত আছেন। তিনি স্বনামধন্য উক্ত জামেয়ার প্রতিষ্ঠতা পরিচালক হিসেবে প্রায় দুই দশক ধরে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এবং জামেয়া পরিচালনার পাশাপাশি বোখারী শরীফ সহ আরবী সাহিত্যের বিষয়ে পাঠদান করেন। বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের ডাক অনেকে দিলেও তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি শুধু ডাক দিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং দারুল মা‘আরিফের মত আদর্শ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে জাতির শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক দিনের বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়েছেন। এ জন্য পুরো জাতি আজ তার কাছে কৃতজ্ঞ।
বহির্বিশ্বের সফর ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাত: আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য সেমিনার ও দাওয়াতি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে বহুদেশে সফর করেছেন। নিম্মে সফরগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পেশ করা হল।
১৯৮১ সালে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সেমিনারে যোগ দিতে তিনি আবর ভারত গমন করেন। উক্ত সেমিনারে তিনি ‘ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে আরবী সাহিত্য পাঠ নির্বাচন’ বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বেশ প্রশংসিত হন। সেমিনারে অংশগ্রহষেণর সুবাদে ইসলামী জগতের খ্যাতিমান লেখক-সাহিত্যিক ও করিদের সাথে তার পরিচিতি ঘটে। এ সফরে আল্লামা সুলতান যওক নদভী রহ, নদওয়ার বিশিষ্ট উস্তাজ মাওলানা রাবে হাসানী নদভী, ড. সাঈদুর রহমান আল-আজমী, মাওলানা ড. আবদুল্লাহ আব্বাস নদভী, মাওলানা ওয়াজেহ রশিদ নদভী প্রমূখের মত আন্তর্জতিক ইসলামী ব্যক্তিত্বদের সাথে বেশ কিছু সময় কাটানোর সুযোগ লাভ করেন।
১৪০৫ হিজরী নব প্রতিষ্ঠিত আদর্শবিদ্যাপীঠ দারুল মা‘আরিফের পাঠ্যক্রমের উপর মতবিনিময় ও দিকনির্দেশনার জন্য তিনি ভারত গিয়ে আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. সহ অন্যান্য নদওয়ার শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের সাথে মিলিত হন। এ সফরে তিনি আল্লামা মঞ্জুর নোমানীর সাথে সাক্ষাত করে হাদীস বর্ণনার অনুমতি লাভ করেন।
১৯৯০ সালে উপসাগরীয় সমস্যার পর্যালোচনার জন্য রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামীর আহ্বানে মক্কা মোকাররমায়া অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্সে যোগদান করেন। এ সফরে সৌদি সরকারের ব্যবস্থাপনায় বায়তুল্লাহ শরীফের অভ্যন্তরে প্রবেশের বিরল সুযোগ লাভ করেন।
১৪০০ হিজরীতে দারুল উলুম দেওবন্দের শত বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে যোগদান করতে ভারত গমন করেন। সেখানে এক অধিবেশনে বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর সাথে সাক্ষাত হয়।
১৪০১ হিজরীতে নদওয়াতুল উলামার দাওয়াতে ‘শিক্ষা কারিকুলাম পর্যালোচনা’ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়ে ভারত সফর করেন। এ সফরে আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ তাকে বংলাদেশে নদওয়া চিন্তাধারার প্রতিনিধি বলে সম্মানিত করেন।
১৪০২ হিজরী মোতাবেক ১৮৮২ ইংরেজীতে তিনি গবেষণামূলক এক জ্ঞন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য লিবিয়ায় সফর করেন। বিশ্বের ৩৬ টি দেশের ৭৪ জন স্কলারের মধ্যে আল্লামা সুলতান যওক নদভী ‘ইসলাম ও নারী’ বিষয়ক প্রবন্ধের জন্য ২য় স্থান অধিকার করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করেন।
১৪০৬ হিজরী মোতাবেক ১৯৮৬ সালে নদওয়াতুল ওলামা লক্ষ্মৌতে রাবেতা আল-আদব আল-ইসলামীর আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দিতে লক্ষ্মৌ গমন করেন। এ সেমিনারের বিষয়বস্তু ছিল ‘ইখতিয়ারুন নুসুস আল আরবিয়্যাহ মিন বিজহাতে নযরিল ইসলামিয়্যাহ’ ওয প্রবন্ধটি নদওয়া থেকে প্রকাশিত ‘আল বাসুল ইসলামী’ ম্যাগাজিনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
১৯৯০ সালে তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত রাবেতা আল-আদব আল-ইসলামীর প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন এবং ‘আল ইত্তেজাহাত আল আদবিয়্যা লি মুসতাওয়া আত তিফিল’ বাংলাদেশে শিশু সাহিত্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে প্রবন্ধটি ‘আল আদব আল ইসলামী’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।
১৯৯২ সালে ভারতের রায়বেরেলী অঞ্চলে ‘বাংলাদেশে ইসলামী দাওয়াতের চর্চা’ শিরোনামে প্রবন্ধ নিয়ে এক সম্মেলনে যোগদান করেন।
১৯৮৪ সালে ‘জময়িয়াতুশ শাবাব,ভারত’ এর ব্যবস্থাপনায় ভারতের মাদ্রাসা সমূহে শিক্ষাক্রমের উপর পর্যলোচনা শীর্ষক একটি সেমিনারে যোগ দিতে ভারত গমন করেন এবং সে সেমিনরের এক অধিবেশনে সভাপতির আসন অলংকৃত করার বিরল গৌরব অর্জন করেন।
১৯৯৯ সালে সৌদি সরকারের আমন্ত্রণে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জাতীয় উৎসবে উপস্থিত হন। সেখানে তার উপস্থাপিত প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘দওরুল আরব ফি নশরিল ইসলাম ওয়াস সাকাফাতিল ইসলামিয়া ওয়াল বিলাদিল মুতাখমাহ।
২০০০ সালে বিয়াদস্থ কিং সউদ ইউনিভার্সিটির আমন্ত্রণে সৌদি আরবের বাদশা ফাহাদের শাসনব্যবস্থার বিশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সৌদি রাজধানী রেয়াদে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে গমন করেন।
২০০০ সালে রাবেতা আল আদব আল ইসলামী’র ট্রাষ্ট বোর্ডের ১৫তম বৈঠকে অংশ গ্রহণের লক্ষ্যে মিশরের রাজধানী কায়রোতে সফর করেন এবং পরবর্তীতে ২০০১ সালেও ১৬তম বৈঠকে তিনি কায়রোতে গমন করে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
২০০১ সালে সৌদি আরবের বাদশা ফাহাদের কর্মময় জীবন উৎসবে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে রাজধানী রিয়াদে উপস্থিত হন।
২০০৪ সালে রাবেতা আল আলম আল ইসলামী এর ১৭ তম ট্রাষ্ট বোর্ডের মিটিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য মরক্কোর অন্যতম শহর ফাসে গমন করেন।
২০০৬ সালে রাবেতা আল আলম আল ইসলামীর ব্যবস্থাপনায় শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত ‘ইসলামে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ শীর্ষক সেমিনারে উপস্থিত হন। সেমিনারে তার উপস্থাপিত প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘ইসলামে মানবাধিকার’।
২০০৬ সালে সর্বশেষ বর্হিবিশ্বে সফর ছিল কওয়েতস্থ আওকাফ ও ইসলামিক এফিয়ার্স মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় কয়েত গমন। সেখানে শেখ ড. ইফসুফ আল-হাজ্জী ও শেখ নাদের আন নুরী এবং বিশ্ব বরেণ্য ইসলাশী ব্যক্তিত্ব শেখ আব্দুল্লাহ আলী আল মতাওয়া এর সন্তানদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন। এবং আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ‘আল মুজতামায়’ তার প্রদত্ত সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।
এছাড়াও আফগানিস্তার, শ্রীলংকা, কাতার, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমূহে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের সাহিত্য সেমিনার, কনফারেন্স, সাংবাদিক সম্মেলন ইত্যাদিতে যোগদান করে দেশ ও জাতির কথা বিশ্বের গুনীজনদের সামনে তুলে ধরেছেন।
রচনাবলী ও সাক্ষাৎকার: বহু ভাষাবিদ আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী একজন সুসাহিত্যিক ও লেখক। বিভিন্ন ভাষায় তার অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, রচনা, সাক্ষাৎকার, কবিতা ‘আল বাসুল ইসলামী’ ‘আল মুজতামা‘আ’ ‘আল আদাবুল ইসলামী’ ‘আল আলামুল ইসলামী’ ‘আল ওয়াউল ইসলামী’ র মত আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। তার রচনা সম্ভার অনেক বিস্তৃত। নিম্মে তার প্রকাশিত কিতাবের উল্যেখযোগ্য কয়েকটির তালিকা দেয়া হল।
১. আত্তরীকু ইলাল ইনশা (আরবী রচনাশৈলী)- ৩খন্ড
২. কাসাসুন নাবীয়্যীন টিকা- টিপ্পনী ও অনুশীলনী সংযোজন- ৩খন্ড
৩. যাদুত ত্বলিবীনের ব্যাখ্যাগ্রন্থ (উর্দু)
৪. নুখবাতুল আহাদিস (হাদীস পুস্তিকা)
৫. শিক্ষা সংস্কারের ডাক (বাংলা ও আরবী ভাষায় প্রকাশিত)
৬. শিশুদের আরবী ভাষা শিক্ষা সিরিজ (১-৪) ক. ইশরুনা দরসান খ.আল-কিতাবুল আরবিয়্যাহ (২ খন্ড) গ. আল-কিরাতু লিররাশিদিন
৭. মুআল্লিমুল ফারসী
৮. রিহলাতী ইলা আরদিল জিহাদ ( আরবী ও বাংলাভাষায় প্রকাশিত)
৯. রাহবারে উর্দু
১০. আসান কাওয়ায়েদ (উর্দু)
১১. তাজকারয়ে আজিজ (মুফতি আজিজুল হক রহ. এর জীবনী)
১২. তাসলিয়াতুল কুলুব (হযরত মাওলানা মুহাম্মদ হারুন বাবুনগরী রহ. এর জীবনী
১৩. আল্লামা ক্বারী মুহাম্মদ তৈয়ব রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী (আরবী)
১৪. আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী (আরবী)
১৫. সাজারাত মিনান নুসুসিল আদাবিয়্যাহ (আরবী সাহিত্য সংকলন)- ২ খন্ড
১৬. কনদে খামাহ শরহে পন্দে নামাহ (উর্দু ভাষায় প্রকাশিত)
১৭. কুল্লিায়াতে যওক (স্বরচিত আরবী, ফারসী ও উর্দু কবিতা সংকলন)
যে সমস্ত কিতাব প্রকাশের অপেক্ষায়:
১. লাহনুল ফুয়াদ (আরবী, উর্দু ও ফার্সী কবিতা সংকলন)
২. আত তালিকুজ জরুরী আলা মাকামাতে হারিরী
৩. আল জানেবুল বালাগী ফী শেরে মুতানাব্বী
৪. কালিমাতুন মুখতারাহ (স্বরচিত বিভিন্ন আরবী প্রবন্ধ সংকলন)
৫. আল খুতাবুল মিম্বারিয়্যাহ
আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও পদাবলী:
১. প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও বুখারী শরীফসহ আরবি সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক। জামেয়া দারুল মা‘আরিফ আল ইসলামিয়া, চট্টগ্রাম।
২. স্থায়ী বোর্ডের সদস্য ও ব্যুরোচীফ বাংলাদেশ- আন্তর্জাতিক ইসলামী সাহিত্য সংস্থা।
৩. সৌদি আরবের গ্রেড মুফতি এফিয়ারের দা‘য়ী।
৪. আন্তর্জাতিক মুসলিম ওলামা সংস্থার সদস্য (মিশর)
৫. চেয়ারম্যান- ইত্তেহাদুল মাদারিস আল আরবিয়্যা চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
৬. প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক- মানারুশ শরক (আরবী ম্যাগাজিন)
৭. প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক- মাসিক আল-হক্ব।
৮. সাধারণ সম্পাদক- খতমে নবুয়্যত বাংলাদেশ।
৯. সাধারণ সম্পাদক- সর্বোচ্চ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ।
১০. নির্বাহি সভাপতি সম্মিলিত মাদ্রাসা পরিষদ, চট্টগ্রাম।
১১. চেয়ারম্যান- আবুল হাসান আলী নদভী ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
১২. খতিব আবু যর গিফারী জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম।
এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মজলিশে সুরার সদস্য।
কওমী সনদের স্বীকৃতি আন্দোলনে আল্লামা সুলতান যওক নদভীর প্রচেষ্টা:
কওমী মাদ্রাসার দাওরা ডিগ্রিকে এম. এ (ইসলামিক স্টাডিজ/আরবী সাহিত্য) ডিগ্রির সমমান দেয়ার লক্ষ্যে বিগত জোট সরকারের নিকট উদ্যোগ গ্রহণকারীদের মধ্যে আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভীর প্রচেষ্ঠা ছিল অন্যতম। এক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে গিয়ে আলেমদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে এক প্লাট ফরমে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। আমরা তার দীর্ঘায়ু কামনা করি।
শেষকথা: আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী একজন জ্ঞানতাপস হলেও তার অবদান বহুমাত্রিক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার প্রশংসনীয় ভূমিকা বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে সম্মান। যেখানেই দ্বীন ও দেশের স্বার্থে তার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তিনি ছুটে গিয়েছেন নি:স্বার্থভাবে। শিক্ষাঙ্গনের বাইরেও দেশ ও জাতি যখনই কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে তার মোকবেলা করার জন্য এগিয়ে এসেছেন। ধর্মীয় স্বার্থে তিনি প্রয়োজনে রাজপথের সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ইসলামের সুমহান বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য আজো তিনি ছুটে যান টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। এ কর্মবীর তার দাওয়াতী মিশনকে ব্যাপৃত করেছেন সামাজিক বিভিন্ন সংস্কার ও সেবামূলক কর্মকান্ডে। অতীতে সর্বদা আমরা তাকে কাছে পেয়েছি অভিবাবকরূপে। আজ আমরা তার মত মহান ব্যক্তিকে বরণ করতে পেরে গর্বিত। তাই জাতির এ সুসন্তানের জন্য আল্লাহর দরবারে বিনীত প্রার্থনা, তিনি যেন মদীনার কাফেলার এ উত্তম নমুনাকে হায়াত দারাজ করে এবং জাতি যেন আরো বেশী দিন তার অনুগ্রহ লাভে ধন্য হতে পারে।
আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী
সংক্ষিপ্ত এক বর্ণাঢ্য জীবনালেখ্য
গ্রন্থনায়- মাওলানা জসিম উদ্দীন নদভী
মাওলানা মুহাম্মাদ আলাউদ্দীন
ভূমিকা: নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি মহেশখালীর কৃতি সন্তান, বিশিষ্ট মুসলিম মণীষী, আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যক্তিত্ব, খ্যাতিমান আরবী সুসাহিত্যিক ও লেখক আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী শুধু বাংলাদেশে নয় মুসলিম বিশ্বে এক পরিচিত নাম। তার বহুমাত্রিক যোগ্যতার কারণে তিনি দেশে যেভাবে বরেণ্য অনুরূপ আন্তর্জাতিক মণীষার কারণে মুসলিম বিশ্বে সমাদৃত। তিনি এ দেশের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন পরিমণ্ডলে অবদান রেখে চলেছেন। বিশেষত: এ দেশে ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। গতানুগতিক সরকারী মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ও পুরোনো কওমী শিক্ষাব্যবস্থার নিগড় ভেঙে একটি যুগোপযোগী ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার ফর্মুলা উপস্থাপন করে তিনি বেশ আলোচিত হন। তার সে শিক্ষা ব্যবস্থার আলোকে চট্টলায় গড়ে উঠেছে ব্যতিক্রকধর্মী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়া। যা ইতিমধ্যেই বিশ্বের বহু দেশের আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও তিনি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধিত্ব করে এদেশের সুনাম বয়ে এনেছেন। তার বর্ণাঢ্য জীবনালেখ্যে আগামী প্রজন্ম খুঁজে পাবে পাথেয়। এ প্রত্যাশায় হিলফুল-ফুযুল কল্যাণ সংস্থা এ সংবর্ধিত মণীষীর সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
জন্ম ও বাল্যজীবন: মহেশখালীর কেন্দ্রীয় এলাকা, বড় মহেশখালীর জাগিরাঘোনা মহল্লায় অনুমানিক ১৯৩৯ সালে এক মধ্যবিত্ত দ্বীনদার পরিবারে আল্লামা সুলতান যওক নদভীর জন্ম। বাল্য কালেই তিনি মমতাময়ী মা রূহ আফজা বেগমকে হারান। পিতা আলহাজ্ব আবুল খায়ের সাহেব পেশায় ব্যবসায়ী হলেও অত্যাধিক ইবাদত বন্দেগী, তাক্বওয়া-পরহেজগারী, আধ্যত্বিকতা ও তাসাইফের প্রতি ধাবিত হওয়ার কারণে সূফী নামে প্রশিদ্ধ ছিলেন। নানা হযরত মাওলানা মকবুল আহমদ ছিলেন হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেব রহ. এর খলীফা হযরত মাওলানা জাফর আহমদ ওসমানীর খলীফা। পিতা আবুল খায়ের সাহেব রূহানী তরবিয়তের প্রতি আসক্ত হওয়ায় সর্বদা হক্কানী আলেম ওলামার সান্নিধ্য কামনা করতেন। তার পরিবারের সাথে আলেম-ওলামা ও জ্ঞানী-গুণীদের সশ্রদ্ধ ভালবাসার সম্পর্ক ছিল। বিশেষত হাকীমুল উম্মত থানভীর প্রসিদ্ধ খলীফা শর্ষদ্বীর মাওলানা নূর বকস সাহেব রহ. সাথে এবং তার ইন্তেকালের পর পটিয়ার হযরত মাওলানা মুফতি আযিযুল হকের রহ. সাথে ছিল তার আত্ত্বিক সম্পর্ক। তাই ছোটকাল থেকেই তার কোমল মনে দ্বীনি কথাবার্তা, যিকির আযকারের হৃদয়গ্রাহী গুঞ্জরণের সুপ্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এভাবে এক রূহানী দ্বীনি পরিবেশে স্বভাবজাত ভদ্রতা, জ্ঞান পিপাসা, বিশুদ্ধ আক্বিদার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠে তার বাল্যজীবন।
শিক্ষা জীবন: নিজ গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে আল্লামা সুলতান যওক নদভীর লেখাপড়ার হাতেকড়ি হয়। সেখানে তিনি বাংলা, অংক, সমাজপাঠ, কায়েদা, আমপারা ও কুরআনের প্রাথমিক পাঠসমূহ গ্রহণ করেন। তারপর স্থানীয় নতুন বাজার জামে মসজিদের অধীনে পরিচালিত ফোরকানিয়ায় কিছুদিন কুরআন মাজীদসহ অন্যান্য বুনিয়াদী তালীম গ্রহণ করেন। তার বাল্যকালের শিক্ষকগণের মধ্যে মরহুম মাওলানা ফজল আহমদ সাহেবের নাম উল্যেখযোগ্য। অত:পর মহেশখালীর প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসায়ে ইসলামিয়া গোরকঘাটায় মিজান-মুনশাইব জামাত ( ৫ম শ্রেণী সমমান) ভর্তি হয়ে তিনি তার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেন। তারপর ইমদাদিয়া কাসেমুল উলুম নতুন বাজার মাদ্রাসায় ভর্তি হলেও সেখানে বেশী দিন লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেনি। হযরত মাওলানা ফজল আহমদ সাহেবের কাছে কিছুদিন প্রাইভেটভাবে পড়েন। ১৩৬৯ হিজরী মাদ্রাসা আশরাফুল উলুম ঝাপুয়ায় ভর্তি হন। আশরাফুল উলুম ঝাপুয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালীন সময়ে এক সফরে জগতবিখ্যাত বুজুর্গ হযরত মুফতী আজিজুল হক সাহেব রহ. সেখানে গেলে তিনি আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভীর অপার সম্ভাবনাময় সুপ্ত প্রতিভা আঁচ করতে পেরে তাকে প্রসিদ্ধ দ্বীনি বিদ্যাপীঠ জামেয় ইসলামিয়া পটিয়ায় গমনের পরামর্শ দেন। ফলে ঝাপুয়ায় একনিষ্ঠভাবে তিন বছর শিক্ষা লাভের পর ১৩৭২ হিজরীতে পাড়ি জমান জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায়। সেখানে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ভর্তি হন। তদানীন্তন দেশ সেরা উস্তাদদের দয়ালু তত্বাবধানে ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকে তার সুপ্ত মেধা ও প্রতিভা। পাঠ্যক্রমের নিয়মিত পড়ালেখার সাথে সাথে চলতে থাকে উর্দু, ফার্সী আর আরবী সাহিত্যের অনুশীলন। ধারাবাহিক অধ্যয়নের কারণে তার মেধার এমন স্ফুরণ ঘটে যে, মাদ্রাসার বার্ষিক রিপোর্টগুলোতে ছাত্রদের সর্বোত্তম সৃষ্টিকর্ম হিসেবে প্রকাশিত রচনার মধ্যে তার রচিত উর্দু, ফার্সী, আরবী বিভিন্ন ক্বসীদা/কবিতা নিয়মিত স্থান পেত। এমনকি কোন গণ্যমান্য মেহমানের মানপত্র রচনা, উস্তাদদের বিভিন্ন ইলমী সহযোগিতা ইত্যাদির দায়িত্ব পড়ত তার উপর। এভাবে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে সুদীর্ঘ ছয় বছর পড়ালেখা করে ইসলামী শরীয়াহ বিভাগ হতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে দাওরায়ে হাদীসের সনদ লাভ করেন। ১৩৭৮ হিজরী মুতাবেক ১৯৫৯ সালে আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভীর প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা শেষ হয়। অবশ্য পরবর্তীতে ১৪০৪ হিজরী সালে তিনি ভারতের লক্ষ্মৌস্থ দারুল উলুম নদওয়াতুল ওলামা হতে সম্মানসূচক ‘আলমিয়াত’ ডিগ্রী লাভ করে নদভী খেতাবে ভূষিত হন।
আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী যাদের পরশ লাভে ধন্য হয়েছেন: দেশ-বিদেশের অসংখ্য শ্রেষ্ঠ বিদ্বান ও বুজুর্গ ব্যক্তির সান্নিধ্য লাভে তিনি ধন্য হয়েছেন। তম্মধ্যে উল্যেখযোগ্য হচ্ছেন হযরত মাওলানা ইমাম সাহেব মোহরভী রহ., হযরত আলহাজ্ব মাওলানা ইফনুছ সাহেব রহ., হযরত মাওলানা আমীর হোসাইন মীর সাহেব রহ., হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইছহাক গাজী সাহেব রহ., হযরত মাওলানা মুফতী ইবরাহীম সাহেব রহ., মাওলানা আলী আহমদ বোয়লভী সাহেব রহ., হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইছহাক হ্ণীলাভী সাহেব মু:জি: (প্রকাশ ছদর সাহেব হুজুর) হযরত মাওলানা নুরুল ইসলাম ক্বদীম রহ., হযরত মাওলানা ইহসানুল হক সাহেব সন্দ্বীপী মু:জি: হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ সাহেব রহ. হযরত মাওলানা হাকীম নুরুজ্জামান সাহেব রহ., হযরত মাওলানা আতীক সাহেব রহ., হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সাহেব রহ., হযরত মাওলানা ফজল আহমদ সাহেব রহ. মাওলানা আব্দুল বারী রহ., মাওলানা আবুল কালাম আনোয়ারভী রহ., হযরত মাওলানা আব্দুস সালাম বণিগ্রামী রহ., হযরত মাওলানা মুজহেরুল হক কুতুবী রহ., হযরত মাওলানা বদীউর রহমান সাহেব রাউজানী প্রমূখ।
বর্হিবিশ্বের যে সকল মনীষীদের কাছ থেকে হাদীছের সনদ অর্জন করেছেন:
হাদীসের উচ্চতর সনদের প্রত্যাশায় তিনি বিদেশের বহু প্রথিতযশা মুহাদ্দিসদের সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছেন। তম্মধ্যে উল্যেখযোগ্য হলেন,
১. তিরমিযী শরীফের বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ মা‘আরিফুস সুনান এর রচয়িতা আল্লামা সৈয়দ ইউসুফ বিন্নুরি রহ. পাকিস্তান- ১৯৫৮ সাল।
২. হাদীস বিশারদ (হাফেজুল হাদীস) আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রহ. পাকিস্তান- ১৩৯০ হিজরী।
৩. মুয়াত্তা মালেকের ব্যাখ্যাগ্রন্থ আওজাজুল মাসালিকের রচয়িতা শায়খুল হাদীস আল্লামা মুহাম্মাদ জাকারিয়া কান্দলভী রহ. পাকিস্তান- ১৯৭৭ সাল।
৪. আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ.- ১৪০১ হিজরী।
৫. আল্লামা মঞ্জুর নোমানী রহ.- ১৪০১ হিজরী।
৬. দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম ও শাইখুল হাদীস আল্লামা ক্বারী মুহাম্মদ তৈয়ব রহ. - ১৯৭৮ সাল।
৭. হযরত মাওলানা ফখরুল হাসান রহ. প্রধান শিক্ষক দারুল উলুম দেওবন্দ- ১৯৭৮ সাল।
৮. হযরত মাওলনা মে’রাজুল হক রহ. মুহাদ্দিস দারুল উলুম দেওবন্দ- ১৯৭৮ সাল।
৯. সিরিয়ার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দেস আল্লামা শেখ আব্দুল ফততাহ আবু গুদ্দাহ রহ.- ১৪১৩ হিজরী।
১০. হযরত মাওলানা আশেক ইলাহী আল-বরনী রহ. (মুহাজির মদীনা) - ১৪১৮ হজরী।
কর্ম জীবন: ১৯৫৯ সালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপনের পর পরম শ্রদ্ধেয় উস্তাজ হযরত মুফতী আজিজুল হক সাহেবের পরামর্শক্রমে মাদ্রাসা রশিদিয় বশরত নগর (চন্দনাইশ)-এ আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভীর শিক্ষকতা জীবনের সূচনা ঘটে। মাদ্রাসায়ে রশিদিয়ায় সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে প্রায় দুই বছর শিক্ষকতার পর ১৯৬০ সালে নেজামে ইসলাম পার্ঠির প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা আতহার আলীর আহবানে কিশোরগঞ্জের তদানীন্তন বিখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইমদাদিয়ায় চলে যান। জামিয়া ইমদাদিয়াকে উপলক্ষ তিনি তখন একটি আরবী কবিতা লিখেন যা ঢাকার প্রসিদ্ধ আরবী সাহিত্যিক আল্লামা আব্দুর রহমান কাশগরী রহ. দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং প্রীত হন। ১৩৮০ সালে মাদ্রাসা হুসাইনিয়া ইয়াহয়াউল উলুম বোয়ালিয়ার মুহতামিম, আল্লামা সুলতান যওক নদভীর মুহতরম শশুর হযরত আলহাজ্ব মাওলানা আলী আহমদ সাহেবের অনুরোধে এক বছর সেখানে অবস্থান করেন। কারণ তার শশুর সাহেব স্বপরিবারে সৌদিয়া হিযরত করেছিলেন। ১৩৮১ হিজরী স্বীয় মুরব্বী হযরত মাওলানা হাজ্বী ইউনুছ সাহেব রহ. এর ডাকে সাড়া দিয়ে ইলম অর্জনের মাতুলালয় জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় পাঠ্যক্রমের উপরের স্তরের কিতাবগুলো পড়ানোর পাশাপাশি মাদ্রাসার সাহিত্যনুরাগী ছাত্রদেরকে ছাত্রদেরকে উর্দু বক্তৃতা প্রশিক্ষণ, উর্দু ভাষায় প্রবন্ধ লেখার নিয়ম-কানুন, বিভিন্ন ভায়ায় কাব্য চর্চা, কবিতা পাঠের আসরের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার মত সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের দায়িত্বও তিনি স্বার্থকতার সাথে পালন করতে থাকেন। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় ‘আল-কাসেম’ নামে উর্দু ভাষায় একটি সাপ্তাহিক দেয়ালিকা প্রকাশ পেত। উল্যেখ্য, তখন এ উপমহাদেশে উর্দুই ছিল সাহিত্যচর্চার প্রধান মাধ্যম। তার সংস্পর্শে এ সময় জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ার ছাত্রদের মধ্যে বিভিন্ন ভায়ায় সাহিত্য চর্চার যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তার ছিল অভূতপূর্ব। উর্দু ভাষায় তার ঈর্ষণীয় পান্ডিত্যের কারণে শিক্ষাঙ্গনের বাইরেও তিনি অনেক উর্দু ভাষাভাষীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সর্বোচ্চ আসন অলংকৃত করে প্রসংশিত হন।
১৩৮৫ হিজরী মোতাবেক ১৯৬৫ সালে একটি যুগোপযোগী আদর্শ দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মানসে তিনি প্রথমবারের মত পটিয়া ত্যাগ করেন এবং সমমনা বন্ধুবর আলেম কামাল উদ্দীন রহ. কে সাথে নিয়ে আগ্রাবাদে কাসেমুল উলুম নামে একটি আদর্শ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৩৮৫ হিজরী সালে যুগশ্রেষ্ঠ বুযুর্গ আল্লামা মুহাম্মাদ হারুন বাবুনগরী রহ. এর পরামর্শে মাদ্রাসায়ে আযীযুল উলুম বাবুনগরে শিক্ষক হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন। এখানেই তিনি উপরস্তরের আরবী সাহিত্য ও হাদীসের পাঠ দানের পাশাপাশি মুফতি পদে দায়িত্ব পালন করেন এবং ছাত্রদের সাহিত্য চর্চার জন্য ‘নাদিয়াতুল আদব’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি তিনি যুগশ্রেষ্ঠ বুযুর্গ আল্লামা মুহাম্মাদ হারুন বাবুনগরীর সান্নিধ্যে থেকে আধ্যাত্মিক জগতেও পরিপক্ক হয়ে উঠেন। সুদীর্ঘ চার বছর পর ১৯৭০ সালের সঙ্গীন সময়ে তিনি ‘সুজাআত’ নামক একটি উর্দু পত্রিকায় লিখনী বিভাগে যোগ দেন। পরবর্তীতে তার উর্দু ভাষায় দক্ষতা বুঝতে পেরে পত্রিকার সম্পাদক তাকে প্র“পরিডার বিভাগে প্রমোশন দেন। পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলে তার যোগ্যতার প্রতি এতই মুগ্ধ ছিলেন যে, ব্যাকরণগত যে কোন সমস্যায় পড়লে তারা আল্লামা সুলতান যওক নদভীর শরণভাপন্ন হতো। এ পত্রিকায় তার বেশ কিছু প্রবন্ধ ও কবিতাও প্রকাশিত হয়।
১৯৭১ সালের রাজৗনতিক পটপরিবর্তনের পর ১৩৯২ হিজরী তিনি জামেয়া ইসলামিয় পটিয়ায় দ্বিতীয় বারের মত তালীমী খেদমতে নিয়োজিত হন। তাহাভী শরীফ, তিরমিজী শরীফ, মিশকাতসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কিতাবের দরস প্রদানের পাশাপাশি আরবী ভাষা বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতা, আরবী ভাষা একাডেমি প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি সৃজনশীল কর্মের আঞ্জাম দিতে থাকেন। এ সময় ‘আসসুবহুল জদীদ’ নামে একটি ত্রৈমাসিক আরবী পত্রিকা তার সম্পাদনায় নিয়মিত বের হতো, যা অল্প সময়ের মধ্যে বিদগ্ধ গুণীজনের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিল।
আল্লামা সুলতান যওক নদভীর ভারত সফর ও নদওয়াতুল ওলামার সাথে সম্পৃক্ততা:
১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত আন্তর্জতিক সাহিত্য সেমিনারে অংশ নিতে তিনি ভারত গমন করেন এবং বিশ্ববিখ্যাত নদওয়াতুল ওলামায় দুই মাস অবস্থান করেন। এ সময়ের মধ্যে প্রখ্যাত আরবী সাহিত্যিকদের সাথে তার পরিচয় ঘটে। ১৯৮৬ সালে রাবেতা আল-আদব আল-আসলামীর ট্রাস্ট বোর্ডের সদস্য হিসেবে আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী নিযুক্ত এবং বাংলাদেশ আঞ্চলিক অফিসের চেয়ারম্যান ঘোষিত হন। সেখানে অবস্থানকলে নদওয়ার মত বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে একটি ইনশা ও আদব ক্লাস নিয়ে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করেন। তার প্রখর মেধা ও যোগ্যতার কারণে নদওয়ার কর্তৃপক্ষ তাকে সম্মানসূচক উপাধী ‘নদভী’ লেখার অনুমতি প্রদান করেন। ১৯৮৪ সালে তারই আমন্ত্রণে বিশ্ববিখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. বাংলাদেশ সফর করেন এবং যুগ চাহিদার মানসে একটি স্বতন্ত্র মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাকে পরামর্শ দেন। তারই উদ্যোগে রাবেতা আল-আদব আল-ইসলামীর ব্যবস্থাপনায় জামেয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়ায় ১৯৯৪ সালে আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভীর সাভাপতিত্বে ‘প্রাচ্যের জাতিগুলোর ভাষা ও সাহিত্যে ইসলামী প্রভাব’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সাহিত্য সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি সাহিত্যিকগণ উপস্থিত ছিলেন। সে আন্তর্জাতিক সেমিনারে আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী ‘বাংলা সাহিত্যে ইসলামের প্রভাব (আরবী ভাষায়)’ বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
জামেয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়া ঃ
আল্লামা সুলতান যওক নদভীর স্বপ্নের বাস্তবায়ন: ১৯৮৫ সালে জামেয়া পটিয়া থেকে ইস্তেফা দিয়ে জামেয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। জ্ঞানের প্রাচীন মূলনীতির উপর অটল থেকে আধুনিক উপকারী বিষয়গুলোর সমন্বয়ে গঠিত উক্ত মাদ্রাসার সিলেবাসটি বেশ যুগোপযোগী বলে দেশ-বিদেশে প্রমাণিত ও সমাদৃত হয়েছে। বিশ্বের নামকরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এ জামেয়ার শিক্ষাক্রমকে অনুমোদন করেছে এবং বিশ্বের বহু দেশ থেকে এমনকি আরব বিশ্ব থেকে পাঁচশত যোগ্য ছাত্র বের হয়ে দেশ-বিদেশের খেদমতে নিয়োজিত আছেন। তিনি স্বনামধন্য উক্ত জামেয়ার প্রতিষ্ঠতা পরিচালক হিসেবে প্রায় দুই দশক ধরে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এবং জামেয়া পরিচালনার পাশাপাশি বোখারী শরীফ সহ আরবী সাহিত্যের বিষয়ে পাঠদান করেন। বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের ডাক অনেকে দিলেও তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি শুধু ডাক দিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং দারুল মা‘আরিফের মত আদর্শ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে জাতির শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক দিনের বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়েছেন। এ জন্য পুরো জাতি আজ তার কাছে কৃতজ্ঞ।
বহির্বিশ্বের সফর ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাত: আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য সেমিনার ও দাওয়াতি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে বহুদেশে সফর করেছেন। নিম্মে সফরগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পেশ করা হল।
১৯৮১ সালে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সেমিনারে যোগ দিতে তিনি আবর ভারত গমন করেন। উক্ত সেমিনারে তিনি ‘ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে আরবী সাহিত্য পাঠ নির্বাচন’ বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বেশ প্রশংসিত হন। সেমিনারে অংশগ্রহষেণর সুবাদে ইসলামী জগতের খ্যাতিমান লেখক-সাহিত্যিক ও করিদের সাথে তার পরিচিতি ঘটে। এ সফরে আল্লামা সুলতান যওক নদভী রহ, নদওয়ার বিশিষ্ট উস্তাজ মাওলানা রাবে হাসানী নদভী, ড. সাঈদুর রহমান আল-আজমী, মাওলানা ড. আবদুল্লাহ আব্বাস নদভী, মাওলানা ওয়াজেহ রশিদ নদভী প্রমূখের মত আন্তর্জতিক ইসলামী ব্যক্তিত্বদের সাথে বেশ কিছু সময় কাটানোর সুযোগ লাভ করেন।
১৪০৫ হিজরী নব প্রতিষ্ঠিত আদর্শবিদ্যাপীঠ দারুল মা‘আরিফের পাঠ্যক্রমের উপর মতবিনিময় ও দিকনির্দেশনার জন্য তিনি ভারত গিয়ে আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. সহ অন্যান্য নদওয়ার শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের সাথে মিলিত হন। এ সফরে তিনি আল্লামা মঞ্জুর নোমানীর সাথে সাক্ষাত করে হাদীস বর্ণনার অনুমতি লাভ করেন।
১৯৯০ সালে উপসাগরীয় সমস্যার পর্যালোচনার জন্য রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামীর আহ্বানে মক্কা মোকাররমায়া অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্সে যোগদান করেন। এ সফরে সৌদি সরকারের ব্যবস্থাপনায় বায়তুল্লাহ শরীফের অভ্যন্তরে প্রবেশের বিরল সুযোগ লাভ করেন।
১৪০০ হিজরীতে দারুল উলুম দেওবন্দের শত বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে যোগদান করতে ভারত গমন করেন। সেখানে এক অধিবেশনে বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর সাথে সাক্ষাত হয়।
১৪০১ হিজরীতে নদওয়াতুল উলামার দাওয়াতে ‘শিক্ষা কারিকুলাম পর্যালোচনা’ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়ে ভারত সফর করেন। এ সফরে আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ তাকে বংলাদেশে নদওয়া চিন্তাধারার প্রতিনিধি বলে সম্মানিত করেন।
১৪০২ হিজরী মোতাবেক ১৮৮২ ইংরেজীতে তিনি গবেষণামূলক এক জ্ঞন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য লিবিয়ায় সফর করেন। বিশ্বের ৩৬ টি দেশের ৭৪ জন স্কলারের মধ্যে আল্লামা সুলতান যওক নদভী ‘ইসলাম ও নারী’ বিষয়ক প্রবন্ধের জন্য ২য় স্থান অধিকার করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করেন।
১৪০৬ হিজরী মোতাবেক ১৯৮৬ সালে নদওয়াতুল ওলামা লক্ষ্মৌতে রাবেতা আল-আদব আল-ইসলামীর আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দিতে লক্ষ্মৌ গমন করেন। এ সেমিনারের বিষয়বস্তু ছিল ‘ইখতিয়ারুন নুসুস আল আরবিয়্যাহ মিন বিজহাতে নযরিল ইসলামিয়্যাহ’ ওয প্রবন্ধটি নদওয়া থেকে প্রকাশিত ‘আল বাসুল ইসলামী’ ম্যাগাজিনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
১৯৯০ সালে তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত রাবেতা আল-আদব আল-ইসলামীর প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন এবং ‘আল ইত্তেজাহাত আল আদবিয়্যা লি মুসতাওয়া আত তিফিল’ বাংলাদেশে শিশু সাহিত্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে প্রবন্ধটি ‘আল আদব আল ইসলামী’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।
১৯৯২ সালে ভারতের রায়বেরেলী অঞ্চলে ‘বাংলাদেশে ইসলামী দাওয়াতের চর্চা’ শিরোনামে প্রবন্ধ নিয়ে এক সম্মেলনে যোগদান করেন।
১৯৮৪ সালে ‘জময়িয়াতুশ শাবাব,ভারত’ এর ব্যবস্থাপনায় ভারতের মাদ্রাসা সমূহে শিক্ষাক্রমের উপর পর্যলোচনা শীর্ষক একটি সেমিনারে যোগ দিতে ভারত গমন করেন এবং সে সেমিনরের এক অধিবেশনে সভাপতির আসন অলংকৃত করার বিরল গৌরব অর্জন করেন।
১৯৯৯ সালে সৌদি সরকারের আমন্ত্রণে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জাতীয় উৎসবে উপস্থিত হন। সেখানে তার উপস্থাপিত প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘দওরুল আরব ফি নশরিল ইসলাম ওয়াস সাকাফাতিল ইসলামিয়া ওয়াল বিলাদিল মুতাখমাহ।
২০০০ সালে বিয়াদস্থ কিং সউদ ইউনিভার্সিটির আমন্ত্রণে সৌদি আরবের বাদশা ফাহাদের শাসনব্যবস্থার বিশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সৌদি রাজধানী রেয়াদে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে গমন করেন।
২০০০ সালে রাবেতা আল আদব আল ইসলামী’র ট্রাষ্ট বোর্ডের ১৫তম বৈঠকে অংশ গ্রহণের লক্ষ্যে মিশরের রাজধানী কায়রোতে সফর করেন এবং পরবর্তীতে ২০০১ সালেও ১৬তম বৈঠকে তিনি কায়রোতে গমন করে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
২০০১ সালে সৌদি আরবের বাদশা ফাহাদের কর্মময় জীবন উৎসবে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে রাজধানী রিয়াদে উপস্থিত হন।
২০০৪ সালে রাবেতা আল আলম আল ইসলামী এর ১৭ তম ট্রাষ্ট বোর্ডের মিটিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য মরক্কোর অন্যতম শহর ফাসে গমন করেন।
২০০৬ সালে রাবেতা আল আলম আল ইসলামীর ব্যবস্থাপনায় শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত ‘ইসলামে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ শীর্ষক সেমিনারে উপস্থিত হন। সেমিনারে তার উপস্থাপিত প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘ইসলামে মানবাধিকার’।
২০০৬ সালে সর্বশেষ বর্হিবিশ্বে সফর ছিল কওয়েতস্থ আওকাফ ও ইসলামিক এফিয়ার্স মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় কয়েত গমন। সেখানে শেখ ড. ইফসুফ আল-হাজ্জী ও শেখ নাদের আন নুরী এবং বিশ্ব বরেণ্য ইসলাশী ব্যক্তিত্ব শেখ আব্দুল্লাহ আলী আল মতাওয়া এর সন্তানদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন। এবং আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ‘আল মুজতামায়’ তার প্রদত্ত সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।
এছাড়াও আফগানিস্তার, শ্রীলংকা, কাতার, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমূহে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের সাহিত্য সেমিনার, কনফারেন্স, সাংবাদিক সম্মেলন ইত্যাদিতে যোগদান করে দেশ ও জাতির কথা বিশ্বের গুনীজনদের সামনে তুলে ধরেছেন।
রচনাবলী ও সাক্ষাৎকার: বহু ভাষাবিদ আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী একজন সুসাহিত্যিক ও লেখক। বিভিন্ন ভাষায় তার অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, রচনা, সাক্ষাৎকার, কবিতা ‘আল বাসুল ইসলামী’ ‘আল মুজতামা‘আ’ ‘আল আদাবুল ইসলামী’ ‘আল আলামুল ইসলামী’ ‘আল ওয়াউল ইসলামী’ র মত আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। তার রচনা সম্ভার অনেক বিস্তৃত। নিম্মে তার প্রকাশিত কিতাবের উল্যেখযোগ্য কয়েকটির তালিকা দেয়া হল।
১. আত্তরীকু ইলাল ইনশা (আরবী রচনাশৈলী)- ৩খন্ড
২. কাসাসুন নাবীয়্যীন টিকা- টিপ্পনী ও অনুশীলনী সংযোজন- ৩খন্ড
৩. যাদুত ত্বলিবীনের ব্যাখ্যাগ্রন্থ (উর্দু)
৪. নুখবাতুল আহাদিস (হাদীস পুস্তিকা)
৫. শিক্ষা সংস্কারের ডাক (বাংলা ও আরবী ভাষায় প্রকাশিত)
৬. শিশুদের আরবী ভাষা শিক্ষা সিরিজ (১-৪) ক. ইশরুনা দরসান খ.আল-কিতাবুল আরবিয়্যাহ (২ খন্ড) গ. আল-কিরাতু লিররাশিদিন
৭. মুআল্লিমুল ফারসী
৮. রিহলাতী ইলা আরদিল জিহাদ ( আরবী ও বাংলাভাষায় প্রকাশিত)
৯. রাহবারে উর্দু
১০. আসান কাওয়ায়েদ (উর্দু)
১১. তাজকারয়ে আজিজ (মুফতি আজিজুল হক রহ. এর জীবনী)
১২. তাসলিয়াতুল কুলুব (হযরত মাওলানা মুহাম্মদ হারুন বাবুনগরী রহ. এর জীবনী
১৩. আল্লামা ক্বারী মুহাম্মদ তৈয়ব রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী (আরবী)
১৪. আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী (আরবী)
১৫. সাজারাত মিনান নুসুসিল আদাবিয়্যাহ (আরবী সাহিত্য সংকলন)- ২ খন্ড
১৬. কনদে খামাহ শরহে পন্দে নামাহ (উর্দু ভাষায় প্রকাশিত)
১৭. কুল্লিায়াতে যওক (স্বরচিত আরবী, ফারসী ও উর্দু কবিতা সংকলন)
যে সমস্ত কিতাব প্রকাশের অপেক্ষায়:
১. লাহনুল ফুয়াদ (আরবী, উর্দু ও ফার্সী কবিতা সংকলন)
২. আত তালিকুজ জরুরী আলা মাকামাতে হারিরী
৩. আল জানেবুল বালাগী ফী শেরে মুতানাব্বী
৪. কালিমাতুন মুখতারাহ (স্বরচিত বিভিন্ন আরবী প্রবন্ধ সংকলন)
৫. আল খুতাবুল মিম্বারিয়্যাহ
আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও পদাবলী:
১. প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও বুখারী শরীফসহ আরবি সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক। জামেয়া দারুল মা‘আরিফ আল ইসলামিয়া, চট্টগ্রাম।
২. স্থায়ী বোর্ডের সদস্য ও ব্যুরোচীফ বাংলাদেশ- আন্তর্জাতিক ইসলামী সাহিত্য সংস্থা।
৩. সৌদি আরবের গ্রেড মুফতি এফিয়ারের দা‘য়ী।
৪. আন্তর্জাতিক মুসলিম ওলামা সংস্থার সদস্য (মিশর)
৫. চেয়ারম্যান- ইত্তেহাদুল মাদারিস আল আরবিয়্যা চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
৬. প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক- মানারুশ শরক (আরবী ম্যাগাজিন)
৭. প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক- মাসিক আল-হক্ব।
৮. সাধারণ সম্পাদক- খতমে নবুয়্যত বাংলাদেশ।
৯. সাধারণ সম্পাদক- সর্বোচ্চ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ।
১০. নির্বাহি সভাপতি সম্মিলিত মাদ্রাসা পরিষদ, চট্টগ্রাম।
১১. চেয়ারম্যান- আবুল হাসান আলী নদভী ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
১২. খতিব আবু যর গিফারী জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম।
এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মজলিশে সুরার সদস্য।
কওমী সনদের স্বীকৃতি আন্দোলনে আল্লামা সুলতান যওক নদভীর প্রচেষ্টা:
কওমী মাদ্রাসার দাওরা ডিগ্রিকে এম. এ (ইসলামিক স্টাডিজ/আরবী সাহিত্য) ডিগ্রির সমমান দেয়ার লক্ষ্যে বিগত জোট সরকারের নিকট উদ্যোগ গ্রহণকারীদের মধ্যে আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভীর প্রচেষ্ঠা ছিল অন্যতম। এক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে গিয়ে আলেমদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে এক প্লাট ফরমে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। আমরা তার দীর্ঘায়ু কামনা করি।
শেষকথা: আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী একজন জ্ঞানতাপস হলেও তার অবদান বহুমাত্রিক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার প্রশংসনীয় ভূমিকা বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে সম্মান। যেখানেই দ্বীন ও দেশের স্বার্থে তার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তিনি ছুটে গিয়েছেন নি:স্বার্থভাবে। শিক্ষাঙ্গনের বাইরেও দেশ ও জাতি যখনই কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে তার মোকবেলা করার জন্য এগিয়ে এসেছেন। ধর্মীয় স্বার্থে তিনি প্রয়োজনে রাজপথের সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ইসলামের সুমহান বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য আজো তিনি ছুটে যান টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। এ কর্মবীর তার দাওয়াতী মিশনকে ব্যাপৃত করেছেন সামাজিক বিভিন্ন সংস্কার ও সেবামূলক কর্মকান্ডে। অতীতে সর্বদা আমরা তাকে কাছে পেয়েছি অভিবাবকরূপে। আজ আমরা তার মত মহান ব্যক্তিকে বরণ করতে পেরে গর্বিত। তাই জাতির এ সুসন্তানের জন্য আল্লাহর দরবারে বিনীত প্রার্থনা, তিনি যেন মদীনার কাফেলার এ উত্তম নমুনাকে হায়াত দারাজ করে এবং জাতি যেন আরো বেশী দিন তার অনুগ্রহ লাভে ধন্য হতে পারে।
No comments:
Post a Comment