Saturday, June 28, 2014

ইরাক কোন পথে ?

22 Jun, 2014
লেখক - সিরাজুল ইসলাম শাহীন  LINK

ইরাক পরিস্থিতি নিয়ে তোলপাড় চলছে।বিদ্রোহীরা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল, সাদ্দাম হোসেনের জন্ম স্থান তিরকিত সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে রাজধানী বাগদাদের দিকে এগিয়ে আসছে।আন্তর্জতিক মিডিয়ায় এটা ক্ষমতাসীন শিয়া সরকারের পতনের লক্ষ্যে সুন্নী ইসলামী জিহাদীদের ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরাক’ গঠনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত অভিযান হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হচ্ছে সরকারী বাহিনীর পরাজয়ের আর ফুটেজ সহ বিদ্রোহীদের নৃসংশতার সংবাদ। মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় কমেন্টের কলামে খৃস্টান সম্প্রদায়ের উপর নিপিড়নের বর্ণনা প্রচার করা হচ্ছে বেশ জোরেশোরে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ঘোষনা করেছেন,তিনি শীঘ্রই ‘ইসলামীস্টদের বিরুদ্বে বিমান নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের বিষয়টি বিবেচনা করবেন।এ লক্ষ্যে ডিফেন্স সেক্রেটারী চাক হেগেল বিমান্ ও মিসাইলবাহী রণতরী ‘এইচ.ডব্লিউ.বুশ’ কে পারস্য উপসাগরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।প্রেসিডেন্ট ওবামা করনীয় নির্ধারনে উপদেস্টাদের সাথে বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছেন। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার পাশ্চাত্যের রাস্ট্র প্রধানদের মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে আরও সক্রিয় ভ’মিকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন,‘পাশ্চাত্যের উচিৎ মধ্যপ্রাচ্যে স্থল বাহিনী সহ সামরিক অভিযান পরিচালনা করা’।তিনি বলেন,‘এই জেহাদী বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপকে এখনই তাদের পথে থামাতে আমাদের স্বার্থ নিহীত রয়েছে’।প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন ইরাকের আই.এস.আই.এস কর্তৃক ইউ.কে. আক্রমনের পরিকল্পনার আশংকা প্রকাশ করেছেন।

ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানী ইরাকের ক্ষমতাসীন ‘নূরী আল মালিকী’ সরকার রক্ষায় একসাথে কাজ করার ইংগীত দিয়েছেন।ইরাকী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন,মাসুল থেকে সেনাবাহীনী প্রত্যাহারের পর সরকারের প্রতিরক্ষার জন্য ইরানের ২০০০ সদস্যের অগ্রবর্তী বাহীনী সীমান্ত অতিক্রম করে এসে পৌঁচেছে।ইতিমধ্যে ইরান তাদের ‘বিপ্লবী কুদস বাহীনী’-র অধিনায়ক জেনারেল কাসেম সুলায়মানীকে বাগদাদ রক্ষায় সমন্বয় করার জন্য পাঠিয়েছে।শিয়া প্রধান নেতা আয়াতুল্লাহ আলী আল সিস্তানী সুন্নী বিদ্রোহীদের বিরুদ্বে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার ডাক দিয়েছেন।এই আহবানে সাড়া দিয়ে দলে দলে শিয়ারা বাগদাদ রক্ষায় সরকারী মিলিশিয়া বাহীনীতে যোগ দিচ্ছেন।

দি ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব মুসলিম স্কলারস সিস্তানীর আহ্বানের প্রতিবাদ জানিয়েছেন ।দোহা ভিত্তিক এই আন্তর্জাতিক সংস্থার বিবৃতিতে বলা হয়,‘ইরাকে যা ঘটছে তা অবিচার ও গণহত্যার বিরুদ্বে স্বাধীনতার জন্য বিক্ষুব্ধ জনতার বিপ্লব’।ড.ইউসুফ আল কারযাভীর নেতৃত্বাধীন সংস্থাটির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়,এই জাগরন শিয়াদের বিরুদ্বে নয় এর বড় প্রমাণ হচ্ছে কোন বেসামরিক শিয়া নিহত হননি এমনকি কোন শিয়া প্রতিবেশীও আক্রান্ত হচ্ছেন না।বিবৃতিতে বলা হয়েছে সাত্তানীর ফতোয়ায় ইরাকীদের বিরুদ্বে ইরাকীদের লড়াইয়ের ডাক দেয়া হয়েছে,যা একটি গৃহযুদ্ব বাঁধাবে, ফলশ্রুতিতে ইরাকের সামাজিক কাঠামোর ভিত্তিমূল ধ্বংস করবে।ইরাকীদের প্রতি রক্তপাত বন্ধ করে জাতীয় ঐক্যমতের সরকার গঠন করে দেশ রক্ষায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে ফেডারেশন।


অবস্থাদৃস্টে মনে হচ্ছে পারস্য উপসাগর সহ ইরাকে পাশ্চাত্যের দীর্ঘমেয়াদী সামরিক উপস্থিতি অনিবার্য্য হয়ে উঠছে।হাজার বছরের মুসলিম সভ্যতার পাদভ’মি-ইরাকে রক্তের হোলি খেলার নবতর অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। মুসলমানদের রক্তে নিজেদের মাটি রন্জিত হতে থাকবে। জমজমাট অস্ত্র ব্যাবসা আর তরল সোনা নিয়ন্ত্রনের অপরাজনীতি যথারিতি চলবে।ব্যত্যয় না ঘটলে অমূল্য ‘স্বাধীনতা’, ইরাকীদের জন্য সোনার হরিন হয়েই থাকবে।তাদের বর্তমান করুণ দৃশ্যের চলমান পর্ব শুরু হয়েছে ২০০৩ সালে যুক্তরাস্ট্রের নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর আভিযানের মধ্য দিয়ে।

Opinion Research Business (ORB)কর্তৃক ২৮ জানুয়ারী ২০০৮ তারিখে প্রকাশিত তথ্য মতে ২০০৩ সালে শুরু হওয়া ইরাক যুদ্বে মৃত্যু ঘটেছে ৯,৪৬,০০০ থেকে ১১,২০,০০০ জনের। যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২.৯% (ইরাকের বর্তমান জনসংখ্যা ৩,৪৯,৯০,২৩৯জন)।আহত সহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি অপরিমেয়। en.m.wikipedia.org এর হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৩ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ইরাকী নিরাপত্তা বাহিনীর ১৭,৬৯০ নিহত ও ৪০,০০০ আহত হয়েছে।এই সময়ে যৌথবাহিনীর নিহত হয়েছে ৪৮০৫ তন্মধ্যে যক্তরাস্ট ৪৪৮৭,যুক্তরাজ্য ১৭৯ ও অন্যান্য ১৩৯জন এবং আহত হয়েছেন ৩২,৭৫৩ তন্মধ্যে যুক্তরাস্ট্র ৩২২২৬,যুক্তরাজ্য ৩১৫ ও অন্যান্য ২১২জন।

এবার সরাসরি ইরানের সংশ্লিস্টতা আর শিয়া-সুন্নি সশস্ত্র যুদ্ব নতুন মাত্রা যোগ করছে।বিধ্বস্ত ইরাকের ঘোরে দাঁড়ানোর অবশিস্ট সম্ভাবনাটুকু বিনাশ হচ্ছে।এই সর্বনাশা পথ রোধ করতে না পরলে জনবল ও সামাজিক কাঠামো ভেংগে পড়ার পাশাপাশি ইরাকের অখন্ডতার্ ক্ষার স্বপ্ন তিরোহিত হতে পারে। শুধু তাই নয়,ইরানের রাস্ট্রীয় নিরাপত্তা হুমকির মূখে পড়তে পারে।নিকট অতীতে ভৃাতৃপ্রতিম দেশ দুটির বিভেদের দগদগে গা এখনও শুকায় নি।২২ সেপ্টেম্বার ১৯৮০ থেকে ২২ আগস্ট ১৯৮৮ পর্যন্ত ৭ বছর ১০মাস ৪ সপ্তাহ ১দিনের ইরাক-ইরান যুদ্বে উভয় পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি সাধিত হয়।এতে ইরাকের নিহত ১,০৫,০০০ থেকে ৩,৭৫,০০০জন(বিভিন্ন সূত্রে),আহত ৪,০০,০০০ জন,বন্দি ৭০,০০০ জন এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৫৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অপর পক্ষে ইরানের নিহত ২,০০,০০০ থেকে ৮,০০,০০০জন;আহত ৩,২০,০০০ থেকে ৫,০০,০০০জন;বন্দি১১০০০ থেকে ১৬০০০জন আর আর্থিক ক্ষতি ৬২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ইরাকের জনগণের দূর্ভাগ্যের রোজ নামচায় বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে ১৯৯০থেকে ফেব্রুয়ারী১৯৯১পর্যন্ত ইরাকের কুয়েত দখল ও সেনা প্রত্যাহার; এপ্রিল ১৯৯১ থেকে ইরাকের অস্ত্র পরিদর্শন বিতর্ক; ইরাকের
নিউক্লিয়ার,রাসায়নিক ও জীবানু অস্ত্র ধংস করতে যুক্তরাস্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যৌথ বোমা হামলা তথা অপারেশন ডেজার্ট ফক্স; ভিন্নমতাবলম্বী ও ইরাকী কুর্দিদের বিরুদ্বে সাদ্দাম হোসেনের বর্বরোচিত পদক্ষেপ; ২০০৩ মার্চে ইরাক যুদ্ব শুরু ও প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের পতন।লাভ-ক্ষতির হিসাবে আর যাই হউক,এসব ঘটনাবলী ক্রমান্বয়ে ইরাকের ধ্বংষ ত্বরান্বিত করেছে মাত্র।রহস্য থেকেই গেল-তাহলে সাদ্দাম হোসেন কেন কুয়েত দখল করতে গেলেন?কেনইবা ইরানের উপর যুদ্ব চাপিয়ে দিলেন?স্বীয় দেশবাসীর উপর জুলুম চালিয়ে সাদ্দাম নিজের শেষরক্ষা করতে পারেন নি।নিজেও গেলেন আর সাথে করে গৌরবময় ইতিহাসের ধারক ইরাকবাসীকে ভয়াবহতম অতল গহ্বরে নিপতিত করলেন।এ থেকে বর্তমান নূরী আল মালিকী সরকার,শিয়া ও সুন্নী নেতৃবৃন্দ আর ইরান,সৌদী আরব,সিরিয়া,বাংলাদেশ সহ মুসলিম রাস্ট্র সমূহের শাসক শ্রেণী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কি এখনও বোধোদয় হবে না?

ইরাকের জনগণের অবাধ মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠন ও দেশ পরিচালনার সুযোগই কেবলমাত্র চলমান সংকট নিরসনের উপায়।নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন পাশ্চাত্যের জন্য এটি হতে পারে ইতিবাচক এবং শান্তীকামী দুনিয়াবাসীর কাছে স্বস্তিদায়ক।বিশ্ব নেতৃত্ব আর ইরাকের ক্রিয়াশীল মহল এ সুযোগ আদৌ গ্রহন করবেন কি না তা সময়ই বলে দেবে।

No comments:

Post a Comment