তালেবানের নারী এবং আলজাজিরার একটি ডকুমেন্টারি
জাহিদ রাজন
Islamic Female Scholar |
তালেবান নারীদেরকে নিয়ে আলজাজিরা একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে যেখানে দেখানো হয়েছে যে তালেবান পুরুষরা মনে করে যে তালেবান নারীরা ঘরে থাকবে এবং তারা কেবল মাত্র কোরআন হাদিস শিখবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের ভূমিকা শুধুমাত্র কোরআন মুখস্ত করা এবং ঘরের কাজে সাহায্য করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। সে ক্লাসেও যদি পুরুষ শিক্ষক থাকে তাকে দেখা যাবে না। তিনি পর্দার আড়াল থেকে পড়াবেন। যদিও একজন শিক্ষক নিজেই স্বীকার করেছেন যে এতে টিচিং এর ইফেক্টিভনেস অর্ধেকে নেমে আসে [১]।
অনেকেই একে ইসলামের একমাত্র সঠিক ইন্টারপ্রিটেশন মনে করেন।কেবলমাত্র আপাত রক্ষণশীল হয়ে নারী পুরুষ আলাদাভাবে থাকলে, কোন ইসলামিক ক্লাসে আলাদা বসলে এটাই ইসলামের একমাত্র সঠিক ধারক বাহক ? সৌদিআরবে নারীদেরকে ড্রাইভ করতে দেয়া বা ভোটাধিকার না দেয়ার মত বাস্তবতা আছে। তাই বলেই সৌদি একটা মডেল ? এটাই রক্ষণশীলতা ?
তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর অনেক নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেয়। যারা তাদেরকে ইসলামের রক্ষাকারী এবং শরিয়াহ এর জ্ঞানে টইটম্বুর মনে করেন তাদের হয়ত জানা নেই যে তালেবানরা আফিম চাষি এবং হেরোইন রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে কয়েক স্তরে ট্যাক্স আদায় করে। জেনে শুনেই করে যে এটা আফিম বা হেরোইন রপ্তানির ট্যাক্স। এই টাকা দিয়ে জিহাদের অর্থ যোগান দেয় [২]। তাদের আরও একটি অন্যতম আয়ের উৎস হল অপহরণ। আমি আমেরিকান নাগরিক অপহরণের কথা বলছি না একেবারে সাধারণ মানুষ অপহরণের কথা বলছি যাদেরকে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয়। এই হল ইসলামের ধারক বাহকদের ইসলামি আয়ের উৎস !
নারীরা রাসুলের হাদিস অনুসারে নিরাপদে একাকী সানা থেকে হাজারা মাউত পর্যন্ত যাত্রার ইতিহাস আছে।
যখন আমরা বলি যে ইসলামকে আমরা সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করব আমরা আসলে জানি না যে এর পরিধি কতটুকু, সে সমাজে মেয়েদের ভূমিকা কি হবে। আমাদের ধারণা নেই যে ইসলামের ইতিহাস কি, সে সময়ে মহিলাদের ভূমিকা কি ছিল, নারী পুরুষ কিভাবে ইন্টারেক্ট করত। ইমাম ইবনুল কাইয়িম যে মসজিদে ইসলাম শিক্ষা দিতেন সে মসজিদের একটি দরজা ছিল। ক্লাস আরম্ভ হলে নারী পুরুষেরা একই সাথে সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করত। এরপর ক্লাসের বিরতিতে তারা কখনো কখনো একই সাথে কথা বার্তা বলত। অনেকেই এতে ফিতনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করতেন। তারা ইমামকে বললেন এতে ফিতনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। মেয়েদের ঘরে থাকা উচিত। ইমাম বললেন- ঘরে বন্দি মূর্খ নারীদের ফিতনা এই ফিত্নার চেয়ে অনেক মারাত্নক [৩]।
প্রখ্যাত তাবেইয়া উম্মু দারদা ছয় মাস মসজিদে আকসা এবং ছয় মাস দামেস্ক এর মসজিদে শিক্ষকতা করতেন। তার হাদিস বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, সুনানে নাসিয়ায়ি,ইবন মাজাহ, এবং ইমাম আহমাদ এর মুসনাদে বর্ণিত হয়েছে। তার ক্লাসে অনেক অনেক পুরুষ লোকেরা তার ছাত্র ছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক মারওয়ান। আব্দুল মালিক মারওয়ানকে হাদিস এবং ফিকহ এর দিক থেকে মদিনার বিখ্যাত হাদিস এবং ফিকহ বিশারদ সাইয়িদ মুসাইয়িব এর সমকক্ষ তুলনা করা হত। আবদুল্লাহ ইবান উমার (রাঃ) যখন মারা যাচ্ছিলেন লোকেরা বলল, “ হে প্রবীণ কুরাইশ আপনি দ্রুতই মারা যাবেন, আপনার মৃত্যুর পর আমরা কাকে জিজ্ঞেস করব ?”। তিনি বললেন- মারওয়ানের একজন ছেলে আছে যে একজন ফকিহ। আব্দুল মালিক মারওয়ান যেহেতু খলিফা ছিলেন তাই ক্লাস শেষে তিনি নামাজের ইমামতি করতেন এবং নিজেই উম্মু দারদাকে মহিলাদের কাতারে যেতে জায়গা করে দিতেন যাতে তিনি নামাজ পড়তে পারেন।
ফাতেমা বিনতে ইব্রাহিম ইবন মাহমুদ ৭১১ হিজরি সালে মারা যান। তিনি সে সময়ের প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ আবু আব্দলুলাহ আল হুসাইন ইবন মোবারক আজ জাবেদি এর কাছ থেকে হাদিস শিখেছিলেন। আজ জাবেদি বাগদাদে পড়াশুনা করেন। ৬৩০ হিজরি সালে কোন এক প্রয়োজনে তিনি দামেস্ক আসেন। দামেস্কের লোকেরা বুঝতে পারে যে তিনি একজন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস। তারা তাকে হাদিস শিখাতে অনুরোধ করে। সে বছরে তিনি দুইবার বুখারি শরিফ শিক্ষা দেন। ইমাম এর কাছ থেকে সে বছরে অনেক নারী-পুরুষ হাদিস শিখেন করেন যার মধ্যে ছিলেন ফাতেমা । তিনি এরপর হজ্ব করলেন। ফাতেমা হাদিসে এতই ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন যে মদিনার উলামারা ফাতিমাকে হাদিস শিক্ষা দিতে বলল।
তিনি মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্র স্থানগুলোর একটি মসজিদে নববীতে হাদিস শিক্ষা দিতেন, রাসুলের রওজায় মাথার পাশে বসেই পড়াতেন এবং মাঝে মাঝে কবরেরর দেয়ালে হেলান দিয়ে বসতেন। মদীনার বিখ্যাত আলেমরা তার ক্লাসে উপস্থিত হতেন। এছাড়াও এর মধ্যে ছিলেন মরক্কোর প্রখ্যাত আলেম আবু আব্দ ল্লাহ সাবতি যিনি মরক্কো থেকে এসেছিলেন। তিনি মরক্কোর সাবতা থেকে মদিনায় এসেছিলেন। তিনি যখন দেখলেন যে ফাতিমা হাদিস শিক্ষা দিচ্ছেন তিনি সে ক্লাসে উপস্থিত হলেন। তিনি লিখেছেন যে ক্লাসে উপস্থিত সবাইকে ফাতিমা নিজ হাতে ইজাজাত লিখে দিতেন যেটিকে আধুনিক সময়ের সার্টিফিকেট এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এছাড়া দামেস্ক এবং মিশরের মসজিদে ইসলামের ইতিহাসে শত শত নারী শিক্ষকতার কাজ করেছেন।
দামেস্কের কোব্বাতুন নসর এর দীর্ঘ ট্রেডিশান আছে যে, সময়ের শ্রেষ্ঠ সিরিয়ান মুহাদ্দিসরা সেখানে বসতেন এবং হাদিস শিখাতেন। তারা এর জন্য খলিফার কাছ থেকে ভাতা পেতেন। যেসব মহিলারা শেখানে শিক্ষকতার কাজ করেছেন এর মধ্যে আছেন আয়িশা বিনতে ইবন আব্দুল হাদি যিনি ৮১৬ হিজরি সালে মারা যান। তিনি সে সময়ের সবচেয়ে প্রখ্যাত হাদিসজ্ঞ ছিলেন। পুরুষদের কেউ তার সমকক্ষ ছিল না। সে সময়ে অন্যান্য প্রখ্যাত লোকেদের মধ্যে তার ছাত্র ছিলেন বুখারির তাফসির কারক বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ফাতহুল বারি’ এর প্রণেতা ইবন হাজার আস কালানি। ইবন হাজার মন্তব্য করেছেন যে এটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে চমৎকার বুখারি শেখার অভিজ্ঞতা। ইবন হাজার তার কাছ থেকে বুখারি ছাড়াও আরও ৭০ টি হাদিস গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। বর্তমানেও ৬/৭ টির বেশী হাদিস গ্রন্থ কোন একজন আলেম পড়ান না। সে সময়ের সিরিয়ার অপর প্রখ্যাত স্কলার ইবন নাসিরুদ্দিন আদ দামেস্কি যাকে ইবন হাজরের সমকক্ষ বিবেচনা করা হয়, তিনি আয়িশার ছাত্র ছিলেন [৪]।
ইসলামের যে স্বর্ণযুগ যেটি জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নত ছিল বলে আমরা এত গর্ব করি সে সময়ে অনেক অনেক নারীরা ইসলামি জ্ঞানের সাথে সাথে সায়েন্স চর্চা করতেন। তারা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে বই লিখেছেন, সূত্র আবিষ্কার করেছেন। সে সময় প্রয়োজনে তারা একটা লেভেল পর্যন্ত পুরুষদের সাথে ইন্টারেক্ট করেছেন। তাদের অনেকেই মুফতি ছিলেন এবং একই সাথে বিজ্ঞানী ছিলেন [৫]।
এক দুইটা বই এবং হাদিস পড়ে, উসুল আল ফিকাহ বা সমসাময়িক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় না এনে, ইসলামের মাকাসেদ আল শরিয়াহ সম্পর্কে না জেনে বা ভাসাভাসা জ্ঞান নিয়ে মেয়েদের কাজ করা উচিত না, মেয়েদের বাইরে যাওয়া উচিত না, নারীদের সাথে বসে পুরুষদের জ্ঞান চর্চা করা উচিত না বলে হুট করে একটা ফেসবুক নোট লিখে বা “ ইসলামি (!) ব্লগ ” লিখে ফেলা বা জেনারালাইজ মতামত দিয়ে দেয়া একটা রোগ। এর চিকিৎসা দরকার।
[১] The Girls of the Taliban https://www.youtube.com/watch?v=vHWuj0SWs84
[২] Conversations With History - Ahmed Rashid https://www.youtube.com/watch?v=OWsmJIwe9Q4
[৩]Islamic Renaissance: The Real Task Ahead with Nouman Ali Khan
[৪] The Female Scholars of Islam | Dr Mohammad Akram Nadwi
[৫] Muslim Women in History facebook page https://www.facebook.com/muslimwomeninhistory
No comments:
Post a Comment