Friday, February 6, 2015

হযরত খান জাহান আলী (রাহঃ)

Source LINK 
হযরত খান জাহান আলী (রঃ) Hazrat Khan Jahan Ali (Rah.)

পাক ভারত উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে এবং একটি ইনসাফ ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে হযরত খান জাহান আলী (রঃ) স্মরণীয় হয়ে আছেন।
তিনি সততা সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে দীর্ঘদিন যশোরাঞ্চল শাসন করেছিলেন। ইসলামের সমস্ত বৈরি শক্তির মোকাবেলায় ঝড়ের বেগে অগ্রসর হয়ে যুদ্ধ করেছেন, জয়ী হয়েছেন, মুসলিম প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং জন হিতকর কার্যে সারাজীবন অতিবাহিত করেছিলেন। ইসলাম প্রচার, ইসলামী ভাবধারার প্রচলন ও ইসলামী সমাজবিধি প্রবর্তনে হযরত উলুঘ খান-ই-জাহান আলী (রঃ) এতদঞ্চলে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি নিজে ইসলাম প্রচার করার সাথে সাথে শিষ্যগণকে বিভিন্ন স্থানে ইসলাম প্রচারের জন্য প্রেরণ করতেন। তাঁর সংগঠনিক ক্ষমতা, জনসেবা ও অকৃত্রিম চরিত্র মাধুর্যে বিমোহিত হয়ে অমুসলিম সমপ্রদায়গুলো দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করত।
তাঁর পূর্বপুরুষেরা বাগদাদের অধিবাসী ছিল বলে জানা যায়। পুঁথি ও কিংবদন্তির মাধ্যমে জানা যায় যে, হযরত খান জাহানের পিতার নাম ছিল আজর খান বা ফরিদ খান। মার নাম ছিল আমিনা বিবি। তাঁরা হযরত বড় পীর (রঃ) এর বংশধর ছিলেন। হযরত খান জাহান আলী (রঃ) এর মূল নাম ছিল শের খান, কিশওয়ার বা কেশর খান। হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করলে আজর খান তাঁর পরিবার নিয়ে দিল্লীতে চলে আসেন। দিল্লীতে কিছুকাল অবস্থান করার পর গৌড়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। আনুমানিক চতুর্দশ শতকের প্রথমার্ধের শেষপাদে অর্থাৎ চল্লিশের দশকে শের খান জন্মগ্রহণ করেন।
আজর খান শিক্ষিত লোক ছিলেন বলে গৌড়ের রাজপরিবারে সহজেই গৃহশিক্ষকের চাকরি লাভ করেন। তিনি শের খানকে গৌড়ের সুফী সাধক এবং বুযুর্গ হযরত নূর-ই-কুতুব-উল আলম (রঃ) এর মক্তবে লেখাপড়া করতে পাঠান। এখানে শের খান শিক্ষা লাভ করেন এবং হযরত নূর-ই-কুতুব-উল আলমের নিকট বায়েৎ হন। পিতা আজর খানের মৃত্যুর পর শের খান শিক্ষা জীবনের ওস্তাদ ও আধ্যাত্নিক নেতা হযরত নূর-ই-কুতুব-উল আলমের শরণাপন্ন হলে তিনি জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহীম শর্কীর কাছে চিঠি লিখে পাঠান। সুলতান শের খানকে সাধারণ সৈনিক হিসেবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করেন। যোগ্যতা ও প্রতিভা বলে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি শের খান সুলতান ইব্রাহীম শর্কির সেনাবাহিনীর সেনাপতি পদে উন্নীত হন। ১৪০০-১৪১১ খৃষ্টাব্দের মধ্যে দিনাজপুরের রাজা গণেশ গৌড়ের সুলতান সাইফুদ্দিন হামযা শাহকে পরাজিত নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। সাথে সাথে তিনি মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালাতে থাকেন। হযরত নূর-ই-কুতুব-উল আলম সুলতান ইব্রাহীম শর্কিকে রাজা গণেশের কার্যকলাপের খবর অবহিত করলেন এবং তাঁর অত্যাচার থেকে মুসলমানদের রক্ষার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখলেন।
শের খানের নেতৃত্বে সুলতান শর্কির সেনাবাহিনী অতি সহজেই রাজা গণেশকে পরাজিত করল। চতুর রাজা সুলতানের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে চিঠি লিখল। রাজা গণেশের পুত্র যদু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জালালউদ্দীন নাম ধারণ করে গৌড়ের শাসনভার গ্রহণ করলেন। কিন্তু রাজা গণেশ পুনরায় নিজ পুত্রের কাছ থেকে শাসনভার গ্রহণ করে মুসলমানদের উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেন। ফলে সুলতান হযরত নূর-ই-কুতুব-উল আলমের নির্দেশে রাজা গণেশকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্য পুনরায় শের খানের নেতৃত্বে এক বিরাট সেনাবাহিনী গৌড়ের দিকে প্রেরণ করেন। এ সংবাদে রাজা গণেশ দলবলসহ দিনাজপুরের দিকে পালিয়ে যান। শের খান বিনাযুদ্ধে গৌড় অধিকার করেন। সুলতান ইব্রাহীম শর্কি শের খানের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে খান-ই-জাহান উপাধি দেন। খান-ই-জাহান উপাধি থেকে বুঝা যায় তিনি প্রথম জীবনে কোন সুলতান বা রাজার মন্ত্রী বা সেনাপতি ছিলেন। এই খান-ই-জাহান নামের আড়ালে বীর সেনাপতির আসল নাম ঢাকা পড়েছে।
হযরত খান জাহান আলী (রঃ) জৈনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কি ও গৌড়ের সুলতান জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ শাহর ইচ্ছায় এবং আধ্যাত্মিক নেতা নুর কুতুব উল আলমের নির্দেশে দক্ষিণ বঙ্গে ইসলামী হুকুমাত কায়েম করার জন্য আসেন। দক্ষিণ বঙ্গের দিকে রওনা হবার পথে তিনি বারোবাজারে প্রথম আস্তানা গাড়েন। সেসময় বারবাজার উন্নত ও নামকরণ বন্দর ছিল। অনুমান করা হয় যে, খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে গঙরিডি রাজ্যের রাজধানী ছিল বারোবাজার। ধরণা করা হয় খান জাহানের আগমন কালে গঙ্গারিডি নামে প্রাচীন শক্তিশালী জাতির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গিয়েছিল। আজও বারোবাজারে প্রাচীন সংস্কৃতির চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। এখানে হযরত খান জাহান আলীর প্রতিষ্ঠিত মসজিদ ও দীঘির ধ্বংসাবশেষ আজও বিদ্যমান। এছাড়া এখানে প্রচুর পুকুর দীঘি রয়েছে। কথিত আছে যে, এখানে ৬ কুড়ি ৬টি অর্থাৎ ১২৬টি দীঘি ছিল। হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলমান আমলে ১০-১২ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে শহর বিস্তৃত ছিল। হযরত খান জাহান আলী (রঃ) ইসলাম প্রচারের জন্য অতি প্রাচীন স্থান বারোবাজারকেই বাছাই করে নেন। তখন বারোবাজারের নাম ছাপাই নগর ছিল। কথিত আছে যে, তাঁর সাথে ষাট হাজার সৈন্য ছিল। তাঁর কীর্তি দেখে বুঝা যায় যে, ষাট হাজার সৈন্য থাকা অমূলক। বারোবাজারে অবস্থানকালে এ অঞ্চলে ব্যাপক ভাবে ইসলাম প্রচার হয়েছিল। এখানে তিনি বেশ কয়েকটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। গোড়া মসজিদ, জোড় বাংলার মসজিদ, চেরাগদানি মসজিদ ও সাতগাছিয়া মসজিদ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
তিনি কিছুকাল বারবাজারে অবস্থানের পর যশোরের মুরলীতে উপস্থিত হন। বেশিদিন তিনি মুড়লীতে অবস্থান করেননি। তবুও তিনি এখানে মসজিদ ও কসবা, গঞ্জ, গড়ে তোলেন। পুকুর ও দীঘি খনন করেন। মুরলী থেকে হযরত খান জাহান আলীর অনুচরবর্গ দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম দল মুরলী থেকে খানপুরে যায়। সেখান থেকে বিদ্যানন্দ কাঠিতে। এখানে বিরাট দীঘি খনন করা হয়েছিল। এ দলের নেতৃত্ব দেন বোরহান খাঁ বা বুড়ো খাঁ। অন্যদল ভৈরব নদীর তীর ধরে পয়গ্রাম কসবত হয়ে বাগেরহাট পৌঁছান। হযরত খান জাহান আলী (রঃ) স্বয়ং এ দলের নেতৃত্ব দেন। যশোরের মুরলী কসবা থেকে তিনি পয়গ্রাম কসবায় যান। এখানে তিনি দশ বৎসর অতিবাহিত করার পর পয়গ্রাম কসবার শাসনভার আবু তাহির নামক এক নবদীক্ষিত মুসলিম যুবকের উপর অর্পন করে বাগেরহাটের দিকে রওনা হন।
হযরত খান জাহান আলী (রঃ) এর প্রধান কীর্তিগুলো হলো বারবাজার, মুরলী কসবা, পয়গ্রাম কসবা ও বাগেরহাট নগরীর প্রতিষ্ঠা। ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ, বিবি বেগেনীর এক গম্বুজ মসজিদ, চুনাখোলা এক গম্বুজ মসজিদ, খান জাহানের বসতবাটী রণবিজয়পুর মসজিদ, খান জাহানের মাযার, পীর আলী মুহাম্মদ তাহিরের মাযার, দরগা মসজিদ, নয় গম্বুজ মসজিদ, সিঙ্গারা মসজিদ, মসজিদ কুড় মসজিদ, তিন গম্বুজ মসজিদ, বাবুটি খানা, খাঞ্জালীর জাঙ্গাল, ঠাকুর দীঘি, ঘোড়া দীঘি, করে দীঘি ইত্যাদিতে তাঁর অমর অবদান রয়েছে যা তাঁকে পৃথিবীতে অবিনশ্বর করে রাখবে।
বাগেরহাটে তাঁর সমাধিগাত্রে উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৪৫৯ খৃষ্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি স্বাধীন সুলতান না থাকলেও স্বাধীনভাবে শাসন কার্য পরিচালনা করতেন। তিনি কারো প্রতিনিধিত্ব স্বীকার করেননি বলে স্বাধীন সুলতানের প্রতিনিধি শাসকও বলা যায় না। তিনি সুলতানী কায়দায় মুদ্রা প্রচলন করেননি। তিনি দুনিয়ার কারো অধীনতার কথাও স্বীকার করেননি। তিনি সাম্রাজ্যের নাম খলিফাবাদ দিয়েছিলেন। খলিফাবাদ অর্থ প্রতিনিধির রাজ্য। মাযার গাত্রের শিলালেখের ধরণ থেকে অনুমিত হয় তিনি নিজেকে আল্লাহর প্রতিনিধি মনে করতেন। দরবেশ নূর কুতুব উল আলম তাঁর আধ্যাত্নিক শিষ্য হযরত খান জাহান আলী (রঃ) কে সম্মানের চোখে দেখতেন। এ কারণে খান জাহান আলী স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন করতেন।
তিনি সুদীর্ঘকাল অত্যান্ত সফলতার সাথে কাজ করেছিলেন। সুলতান নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালে কি তাঁর সামান্য পরে তিনি মারা যান। তিনি জালাল উদ্দীনের সময় থেকে শুরু করে নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালের শেষ পর্যন্ত সুদীঘকাল যশোরাঞ্চল শাসন করেছিলেন। খুব সম্ভবত রাজা গণেশের পুত্র জালাল উদ্দীন মোহাম্মদ শাহের আমলে (১৪১৮-৩২খৃঃ) তিনি শাসনকর্তা হিসেবে বাগেরহাট এসেছিলেন। সেই সময় থেকে আরম্ভ করে সুলতান শামস-উদ-দীন আহমদ শাহের (১৪৩২-৩৬খৃঃ) এবং পরবর্তী সুলতান নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহের রাজত্বকাল (১৪৩৬-৫৯খৃঃ) পর্যন্ত তিনি বৃহত্তর যশোরাঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন। সম্ভবত ৪০ বৎসরকাল স্বাধীনভাবে তিনি এই এলাকা শাসন করেছিলেন। তিনি মহাপুরুষ হিসেবে আমাদের মাঝে আজীবন বেঁচে থাকবেন। তাঁর অবিনশ্বর কীর্তির কথা জগতের মানুষ কখনো ভুলবে না। শাহজাহানের তাজমহল যেমন তাঁকে পৃথিবীতে অমর করে রেখেছে তেমনি ষাট গম্বুজ মসজিদও হযরত খান জাহান আলী (রঃ) কে অমর করে রাখবে। তিনি ছিলেন আছেন এবং আজীবন থাকবেন। জগতের মানুষ তাঁকে কখনোই ভুলবেনা।
তথ্য সংগ্রহ :
হাবিব ইবনে মোস্তফা
সম্পাদনা :
হাবিব ইবনে মোস্তফা
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
শামিউল আমিন শান্ত।

No comments:

Post a Comment